ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

দুদকের অনুসন্ধানে ভয়াবহ চিত্র ॥ প্রতিমন্ত্রীকে রিপোর্ট হস্তান্তর

সংযোগ, বিতরণ, বিল আদায়-তিতাসের সর্বত্র দুর্নীতি

প্রকাশিত: ১১:১১, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

সংযোগ, বিতরণ, বিল আদায়-তিতাসের সর্বত্র দুর্নীতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংযোগ থেকে বিতরণ, বিল আদায় থেকে ব্যাংকে টাকা স্থানান্তর তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সবখানে শুধু দুর্নীতিই পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি নিয়ে দুদক কমিটির অনুসন্ধানে ভয়ঙ্কর এমন দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কাছে বুধবার অনুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ফেঁসে যেতে পারেন তিতাসের বর্তমান ও সাবেক অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীই। নামে বেনামে তিতাসের এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অঢেল বিত্ত বৈভবের মালিক বনে গেছেন বলে দুদকের তথ্য মিলেছে। দুদক বলছে গৃহস্থালির গ্যাসের চাপ ইচ্ছাকৃত কমিয়ে ঘুষ নিয়ে যেসব শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয় সেখানে সরবরাহ বাড়িয়ে দেয় তিতাস। এতে সাধারণ মানুষ গ্যাস পায় না। এর কোন প্রতিকার বছরের পর বছর ধরে সরকারও করে না। শুধু কি তাই আবাসিক গ্রাহকের কাছ থেকে সরবরাহের তুলনায় বেশি অর্থ আদায়ের প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে। অনুসন্ধান শেষে দুদক বলছে আবাসিক খাতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১০ হাজার ৩১৭ কোটি ৬৯ লাখ ৩৫ হাজার ৫৬৮ সিএফটি গ্যাস ব্যবহারের প্রাক্কলন করা হয়। কিন্তু প্রকৃত ব্যবহার তা থেকে ৪১ কোটি ৮৫ লাখ ৬ হাজার ৭০৩ ঘনমিটার কম হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ২৯৩ কোটি টাকা। আবাসিকের বিপুল গ্যাস শিল্পে অবৈধ সংযোগ দিয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। শুধু এই গ্যাসই নয় বিতরণ কোম্পানিটি এত বেশি পরিমাণ অবৈধ সংযোগ দিয়েছে যে মোট বিতরণ করা গ্যাসের ৬ ভাগ তারা সিস্টেম লস দেখাচ্ছে। অর্থাৎ এই গ্যাসও অবৈধভাবে বেঁচে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দুদক বলছে অবৈধ চুলা চিহ্নিত করেও তিতাস তা বিচ্ছিন্ন না করে বৈধ চুলার সমান অর্থ আদায় করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে জিনজিরা, ফতুল্লা, সোনারগাঁও, নরসিংদী ও গাজীপুর এই এলাকায় তিতাসের এক লাখ ১৮ হাজার ৪৫৫ অবৈধ আবাসিক সংযোগ রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিমাসে ৯২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা আদায় করে ভাগ করে নিচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুর্নীতির জনশ্রুতি রয়েছে এমন ২৫টি সরকারী প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি, পরিচালনা পদ্ধতি, সরকারী অর্থ আত্মসাত এবং অপচয়ের দিকগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে এসব প্রতিষ্ঠানের জনসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা, আইনী জটিলতা, সেবাগ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির কারণগুলো চিহ্নিত করে তা বন্ধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২০১৭ সাল থেকে ২৫ প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে দুদক। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি টিমের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, এসব টিম অনুসন্ধান চালিয়ে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে। তিতাস গ্যাস সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম তাদের অনুসন্ধানকালে তিতাস গ্যাস কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা এবং এ বিষয়ে যারা সম্যক ধারণা রাখেন তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করে। তিনি বলেন, কমিশনের এই প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সহজ হবে। এভাবে দুর্নীতি সংঘটনের আগেই তা প্রতিরোধ করা গেলে, মামলা-মোকদ্দমা করার প্রয়োজন পড়বে না। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার যে ঘোষণা দিয়েছে, কমিশন সে ঘোষণা বাস্তবায়নে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এসব প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে যা বাস্তবায়ন করলে দুর্নীতি কমবে বলে মনে করেন তিনি। এক সময় সচিব হিসেবে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও সামলেছেন ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান। তিনি জ্বালানির বাইরেও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। দুদক প্রতিবেদনে বলছে, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সরকারী অডিট রিপোর্ট বলছে, বিভিন্ন শিল্পকারখানা- এরমধ্যে এশিয়ান টেক্সটাইল মিলস, পিংক ফুড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রি, লিথুন ফ্রেব্রিক্স, কুশিয়ারা কম্পোজিট, বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান, সিএনজি প্রতিষ্ঠানসহ শিল্প এবং আবাসিক গ্রাহদের কোটি কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এসব গ্রাহক হয় মামলা করে নয় তো অদৃশ্য চাপে বিল দিচ্ছে না। কিন্তু তিতাস ব্যবস্থা নিলে যা আদায় করা সম্ভব ছিল বলে দুদক মনে করছে। সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ট্রুথ কমিশিন গঠন করা হলে তিতাসের অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী শাস্তির ভয়ে ট্রুথ কমিশনে গিয়ে সত্য বলতে শুরু করেন। ওই সময় ড্রাইভারের মতো তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীরাও ট্রুথ কমিশনে গিয়ে ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকার সম্পদ থাকার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু এরপর ওই সরকারের বিদায় হলে তিতাসের দুর্নীতির বিষয়টি আর সেভাবে আলোচনায় আসেনি। গত নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলে আবার নড়ে চড়ে বসে দুদক। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর তিতাসের ভয়ঙ্কর সব দুর্নীতির তথ্য হাজির করেছে তারা। সরকার যেখানে বেশি দামে এলএনজি এনে সাধারণ মানুষের কাছে কম দামে বিক্রি করছে সেখানে সেই গ্যাসই অবৈধভাবে বিক্রি করে দিচ্ছে তিতাসের কর্মচারী-কর্মকর্তারা। এতে আর্থিক ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। আর লুটেরাদের লুটপাট বন্ধ করতে না পারলেও বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গ্যাসের দাম বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকে সেই টাকা তুলে দিচ্ছে। সম্প্রতি কমিশনের শুনানিতে ভোক্তাদের তরফ থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি না করে দুর্নীতি বন্ধ করলেই আর্থিক সাশ্রয় হবে এমন দাবি করা হয়। কিন্তু কমিশন ওই কথায় কোন কর্ণপাতই করেনি। এখন দুদকের এই প্রতিবেদন বলছে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করছে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তিতাসে ২২ ভাবে দুর্নীতি হওয়ার প্রমাণ মিলেছে অনুসন্ধানে। প্রতিবেদনটিতে এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে দুদক। যদিও সুনির্দিষ্টভাবে কোন তিতাসের কর্মকর্তা কর্মচারীকে দায়ী করা হয়নি। তবে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাদের তিতাস বিশেষভাবে আনুকূল্য দিয়ে আসছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এক সময় সিস্টেম গেইন করত অর্থাৎ তিতাসের লোন সিস্টেম লস তো ছিলই না। পেট্রোবাংলা থেকে যে গ্যাস ক্রয় করত তার থেকে বেশি গ্যাস বিক্রি করত। মূলত আবাসিক গ্রাহকের কাছে যে গ্যাস বিক্রির হিসেব ধরা হতো সেই গ্যাস তারা ব্যবহার করত না। এতে করে সিস্টেম গেইন হতো। কিন্তু এখন ৬ ভাগ সিস্টেম লস হচ্ছে। মূলত বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এসব গ্যাস অবৈধভাবে বিক্রি করে দেয়াতে এই সিস্টেম লস দেখানো হচ্ছে। এর আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীক্ষণ এবং মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) তাদের গবেষণায়ও বিষয়টি দেখিয়েছে। দুদক বলছে, বিতরণ কোম্পানির সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ গ্যাস লাইন রয়েছে। গৃহস্থালির তুলনায় শিল্পেই বেশি অবৈধ লাইন দেয়া হয়েছে। তিতাসের কর্মচারী-কর্মকর্তারাই এভাবে লাইন দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। দুদক বলছে অবৈধভাবে লাইন দিলে বিপুল পরিমাণ টাকা তো সংযোগের সময় পাওয়াই যায়। এর বাইরে প্রতিমাসে আবার বখরা পাওয়া যায়। ফলে অবৈধ সংযোগ বৈধ করার বিষয়ে তিতাসের আগ্রহ কম। একটি অবৈধ সংযোগ পেতে এর আগে প্রায় ৪৫ লাখ টাকা ঘুষ লাগে বলে দুদক জানিয়েছে। এখনও এইভবে সংযোগ দেয়া হচ্ছে তবে তা আরও চড়া দামে বলে দুদক প্রতিবেদনে জানায়। দুদক বলছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দিনে লাইন কেটে দিয়ে রাতের আঁধারে আবার লাগিয়ে দিচ্ছে তিতাসই। ফলে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নামে এক ধরনের আইওয়াশ করা হচ্ছে। অবশ্য দুদক বলছে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং জেলা পর্যায়ে ডিসিদের নেতৃত্বে কমিটি রয়েছে। তবে এই কমিটির উপরও অদৃশ্য হস্তক্ষেপ করা হয়। এই অদৃশ্য হস্তক্ষেপের কারণে অবৈধ সংযোগ যেমন দেয়া হয় সেইভাবে কাটাও যায় না। সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে নির্মিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। শুধুমাত্র সরকারের একটি কমিটির সুপারিশেই গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দুদক বলছে স্বচ্ছতার জন্যই এখানে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত ছিল যা নেই। দুদক প্রতিবেদনে বলছে অনেক ক্ষেত্রে গ্রাহকের শ্রেণী পরিবর্তন করে বাণিজ্যিক শ্রেণীর গ্রাহককে শিল্প গ্রাহক দেখিয়ে কম দামে গ্যাস দিচ্ছে তিতাস। উৎকোচের মাধ্যমে এসব কাজ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। দুদক বলছে মিটার টেম্পারিং করেও কিছু অবৈধ কর্মকর্তা ঘুষের মাধ্যমে গ্রাহকের প্রকৃত বিল কম দেখিয়ে অর্থ আয় করে। দুদক বলছে অনেক ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের বেশি ব্যবহার করার সুযোগ দিচ্ছে তিতাস। অনুসন্ধানে দেখা গেছে গ্যাসের বরাদ্দকৃত লোডে যে ক্ষমতার জেনারেটর এবং বয়লার ব্যবহার করার কথা তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার ব্যবহার করা হচ্ছে। তিতাসের সংশ্লিষ্টরা সব কিছু জানার পরও চুপ করে থাকছে। কেউ বৈধভাবে সংযোগ নিতে চাইলে বিপুল পরিমাণ উৎকোচ আদায় করা হয়। আর ঘুষ দিতে না চাইলে নানা ভাবে হয়রানি করা হয়। দুদক বলছে মিটার বাইপাস করে অনেক শিল্পে গ্যাস সংযোগ দিয়েছে তিতাস। এতে যা বিল আসার কথা তার থেকে কম বিল দিচ্ছে উদ্যোক্তারা। আর মাস শেষে তিতাসের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে সবকিছু ঠিক রাখছে। ঘুষের বিনিময়ে দীর্ঘদিন একই এলাকার থেকে তিতাসের এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবাধে এসব দুর্নীতি করে যাচ্ছে। গ্রাহক যাতে সঠিক চাপে পাওয়া গ্যাসের বিল দিতে পারে এজন্য ইলেক্ট্রিক ভলিউম ক্যারেক্টর (ইভিসি) মিটার লাগানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তিতাস তাদের অবৈধ বাণিজ্যের সম্প্রসারণের জন্য ইভিসি মিটার লাগায় না।
×