ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নাটেশ্বরে মাটির নিচে পিরামিড আকৃতির নান্দনিক স্তূপ

প্রকাশিত: ১১:২০, ১০ এপ্রিল ২০১৯

নাটেশ্বরে মাটির নিচে পিরামিড আকৃতির নান্দনিক স্তূপ

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, নাটেশ্বর থেকে ফিরে ॥ প-িত অতীশ দীপঙ্করের জন্মভূমি বিক্রমপুরের প্রত্নস্থান নাটেশ্বর; দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ব প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে জায়গা করে নেবে। গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত চার মাসের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খননে এখানে পিরামিড আকৃতির নান্দনিক স্তূপের অন্য বাহুসহ বেশকিছু তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কর্মসূচীর গবেষণা পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান প্রেস ব্রিফিংয়ে একথা বলেছেন। এই আয়োজনের প্রধান অতিথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ যথাযথভাবে সুরক্ষা করতে হবে। সঠিক গবেষণার মাধ্যমের এর সঠিক ইতিহাসও স্পষ্ট করতে হবে। এতে বাঙালীর প্রাচীন ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ হবে। পর্যটকদের পদচারণা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা শীর্ষক কর্মসূচীর ২য় পর্যায় আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু নিয়ে মঙ্গলবার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বরের বৌদ্ধ নগরীর পাশে প্রেস কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান লিখিত বক্তব্যে বলেন, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরেও ঐতিহাসিক বল্লালবাড়িতে উৎখননে প্রাচীন বসতির আলামত, হরেক রকমের মৃৎপাত্র, ধাতব ও পাথরের প্রত্নবস্তু, উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ অবশেষসহ প্রভৃতি প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। যা মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের প্রাচীন ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে এবং পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাবে। ইতোপূর্বের আবিষ্কৃত বিভিন্ন বিষয়ও তুলে ধরা হয়। এই আয়োজনে আলোচনা করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) খন্দকার আশফাকুজ্জামন, টঙ্গীবাড়ি উপজেলা নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান জগলুল হালদার ভুতু, মুন্সীগঞ্জ সদর ইউএনও ফারুক আহমেদ, টঙ্গীবাড়ি ইউএনও মোসাম্মৎ হাসিনা আক্তার প্রমুখ। এর আগে প্রতিমন্ত্রী নাটেরশ্বর দেউল ও রঘুরামপুর বৌদ্ধ বিহার এলাকার প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনসমূহ পরিদর্শন করেন। উল্লেখ্য, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সহযোগিতায় ও অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা শীর্ষক কর্মসূচীটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণ বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কাজ শুরু করে। অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ২০১৩-২০১৮ পর্যন্ত খননে পাঁচ হাজার বর্গমিটারের বেশি এলাকা উন্মোচিত হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরীক্ষামূলক খননে বল্লালবাড়ি থেকে প্রাচীন বসতির আলামত পাওয়া গেছে। নাটেশ্বরে পূর্ব-পশ্চিম প্রলম্বিত উত্তর বাহুটি ৪৩ দশমিক পাঁচ মিটার পাওয়া গেছে। নাটেশ্বর পিরামিড আকৃতির বাংলাদেশের বৃহত্তম বৌদ্ধ স্তূপটি ভারতবর্ষের বড় বড় স্তূপ যেমন- সাঁচি, ভারহুত, অমরাবতীর সমগোত্রীয়। বৌদ্ধ স্তূপ বৌদ্ধধর্ম চর্চা কেন্দ্রেও। ২০১০-১৩ পর্যন্ত ৯টি প্রত্নস্থানে পরীক্ষামূলক উৎখনন কাজ পরিচালিত হয়। রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে ৬টি ভিক্ষু কক্ষ, একটি ম-প ও পঞ্চস্তূপ আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সাল থেকে নাটেশ্বর দেউলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বৌদ্ধ মন্দির, অষ্টকোণাকৃতি স্তূপ, ইট নির্মিত রাস্তা, ইট নির্মিত নালাসহ নানা পুরাকীর্তি আবিস্কার হয়। অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান আরও জানান, প্রায় ১০ একর ঢিবিতে উৎখনন কাজের বিশালতা ও সংরক্ষণের কথা চিন্তা করে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন চীনের হুনান প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটকে আমন্ত্রণ জানায়। ২০১৪ সাল থেকে যৌথভাবে নাটেশ্বর দেউলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। আমেরিকার বেটা পরীক্ষাগারে ২৬টি কার্বন-১৪ তারিখ নির্ণয় করা হয়েছে। স্তরায়ন এবং কার্বন-১৪ তারিখের ভিত্তিতে নাটেশ্বর বৌদ্ধ বসতির দুটি সময়কাল পাওয়া গিয়েছে- প্রথম পিরিয়ড ৭৮০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দ এবং দ্বিতীয় পিরিয়ড ৯৫০-১২২৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ইতোমধ্যে রঘুরামপুর ও নাটেশ^রে বিশাল আকারের এবং ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত স্থাপত্যিক নিদর্শনের আবিষ্কার ঐতিহাসিক সূত্রে উল্লেখিত বিক্রমপুরের রাজধানীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইট নির্মিত মন্দির, ম-পসহ অষ্টকোণাকৃতির তিনটি স্তূপ, ৫১ মিটার দীর্ঘ ইট নির্মিত উন্নত প্রযুক্তির রাস্তাসহ মোট ৪টি রাস্তা ও পাশর্^রাস্তা, চারদিকে চারটি স্তূপ, হলঘর, বিশাল আকারের ক্রুশাকৃতির কেন্দ্রীয় স্তূপ, বিভিন্ন কক্ষ, সীমানা প্রাচীর, প্রবেশপথ প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ায় মাটির নিচে আবিষ্কৃত এসব প্রত্নবস্তু বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে পলিথিনের ওপর মাটির বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হবে। এই খনন কাজের এ বছরের সমাপনী হিসেবে এই আয়োজন করা হয় বলে তিনি জানান।
×