ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৯ এপ্রিল ২০১৯

ঢাকার দিনরাত

শনিবার রাতে ৭৪ কিলোমিটার বেগে ঢাকায় বয়ে গেল কালবৈশাখী। আগের রবিবারও বাতাসের গতিবেগ এমনই ছিল। বোশেখ আসার আগে কালবৈশাখী হবে- এ তো বাঁধাধরা নিয়ম; আর রাজধানীও খানিকটা বিপর্যস্ত হবে। কালবৈশাখী তো কেবল ঝড়-বাদলা নয়, নয় বড় বড় মুক্তোদানার মতো শিলার পতন, বরফ ভেবে যা খেয়ে ফেলে আলাভোলা কিশোরী। কালবৈশাখী মানে ঝমঝম বৃষ্টিও। এই বৃষ্টিতে বিপুল জলাবদ্ধতা হয় না বটে! যদিও রাজধানীর অলিগলির ছোট ছোট রাস্তা ছাড়াও বড় বড় সড়কের দু’পাশে জমে যায় পানি। একটা অপরিকল্পিত শহর কত আর ভার নেবে! সন্ধ্যাবেলা অফিস ফেরত হাজারো লোকের কী যে দুর্দশা! ফুটপাথ তো কবে থেকেই বেদখল হয়ে আছে। রাস্তার কিনার ধরে হাঁটার জায়গাটুকুও সঙ্কুচিত বর্ষার কারণে। কিভাবে পথ পেরুবেন পথিকরা? তা ছাড়া যাত্রী-ছাউনি কোথায় পাবেন এ শহরে? ফলে বাধ্য হয়েই বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে কাকভেজা হন অনেকেই, সবাই তো আর হিসেবি নন যে ছাতা রাখবেন সঙ্গে। একেকটা বাস আসে যাত্রীবোঝাই হয়ে। তাতে নতুন যাত্রীর ঠাঁই মিলবে কিভাবে! সারাটা দিন অফিস করে কর্মক্লান্ত শরীরটাকে নিয়ে পরিবারের স্বজনদের কাছে ফেরাটা তাদের বিলম্বিত এবং বিড়ম্বিত হয়। এটাই তো রাজধানীর নিম্ন মধ্যবিত্ত চাকুরেদের চৈত্রের রীতিসিদ্ধ দিনযাপন। নির্বাচিত নতুন নগরপিতার সক্রিয়তার অপেক্ষায় আছে ঢাকা। তিনি কি এই মানুষগুলোর মুশকিল কিছুটা আসানের উদ্যোগ নেবেন? কালবৈশাখীর এক মিনিটের আঘাতে রবিবার রাজধানীর অনেকটাই ল-ভ- হয়ে পড়ার ঘটনায় বোঝা গেল প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা সামান্য। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীর মোট পঁচিশটি স্থানে গাছ ধসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। শাহবাগসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় সড়কের পাশের বিলবোর্ড উড়ে গেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছেন। মাত্র এক মিনিটকাল স্থায়ী মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী রাজধানীবাসীর জন্য সতর্কবার্তা রেখে গেল। প্রকৃতির ওপর মানুষের হাত নেই। তবে মানুষ সচেতন ও সতর্ক হলে ঝড়ের কবলে পড়েও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে পারে। ঢাকার যেসব বড় গাছের গোড়া নরম হয়ে গেছে সেগুলো চিহ্নিত করে কেটে ফেলাই মঙ্গল। আর বিলবোর্ড স্থাপনার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে সেটি মজবুত কিনা। ঝড়ে উড়ে যাওয়ার মতো পলকা হলে তা সমূহ বিপদ ঘটাবে। প্রচণ্ড ঝড়ের সময় যানবাহন বন্ধ রাখার কথাও বলে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। ঝড়ের সময় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান না করাই শ্রেয়। সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে কালবৈশাখীর তাণ্ডব থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। এই সঙ্গে যে কথা না বললেই নয়। ঢাকার প্রতিটি এলাকায় কোন না কোন স্থাপনা বা উঁচু ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। এ ধরনের কর্মযজ্ঞ মানেই নির্মাণ উপকরণের স্তূপ। অসতর্কতায় রাখা ইট, টিন বা কাঠ, লোহানির্মিত সরঞ্জাম ঝড়ে উড়ে এসে মাথায় পড়তে পারে পথচারীর। সত্যি হলে সমূহ বিপদ। মানুষের প্রাণ সংহারের আশঙ্কা। তাই এই ঝড়ের মৌসুমে সব নির্মাণসামগ্রী গুছিয়ে জড়ো করে ও ঢেকে রাখতে হবে যাতে কোন রকম ঝুঁকি না থাকে। এ শহর কি মানুষের? আমরা কেমন শহরে বসবাস করি। কেউ বলবেন, ঢাকা এখন যানজট আর ধুলোর শহর। এককালে ছিল মসজিদের শহর। তারপর বলা হতো রিক্সার শহর। এসব হলো বহিরঙ্গের বাক্যালাপ। ভেতরে ভেতরে ঢাকার মন মরে যাচ্ছে, সে কথা খুব সংবেদনশীল মানুষ ছাড়া কেউ অনুমানই করতে পারবেন না। টিভিব্যক্তিত্ব আবদুন নূর তুষারের বক্তব্য পড়ে চমকে উঠি। সত্যিই তো! একবিন্দু বানিয়ে লেখেননি তিনি। আমরা যারা আশির দশক থেকে ঢাকায় আছি তারা চার দশকে ঢাকার শনৈঃশৈন উন্নতি দেখছি। মুম্বাই-দিল্লীর মতো আলিশান সব ভবনে ভরপুর ঢাকা, কিন্তু ঢাকা পড়ে গেছে তার প্রাণভোমরা। ছোট ছোট বিষয় দিয়ে সেসব বুঝে ওঠা যায়। তুষার লিখেছেন- ‘আমি বই কিনি, পড়ি, সংগ্রহ করি। নিউ মার্কেট থেকে কলাবাগান হয়ে আসাদগেট, প্রতিটি বাসস্টপে ছিল বইয়ের দোকান। কলাবাগানের মোস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে ছিল আমার বিশেষ খাতির। পকেটে টাকা কম থাকলেও বই দিয়ে দিতেন। নাম বললে বই এনে দিতেন। আম্মার জন্য দেশ, সানন্দা, আমার বোন ও পরে আমার মেয়ের জন্য আনন্দমেলা, আলাদা করে রেখে দিতেন তিনি। একটা ফ্রিজে ঠা-া পানি, কোক পেতাম আসাদগেট ও কলেজ গেটের বাসস্টপে। সিটি কর্পোরেশনের বাসস্টপ এখন অধিকাংশ এলাকায় কোন স্থাপনাবিহীন। বয়স্কদের বসার ব্যবস্থা নেই। নেই গর্ভবতী বা অসুস্থ নারী-পুরষ বা শিশুর জন্য কোন বসার জায়গা। শহর আধুনিক হলে সেখানে আধুনিক বাসস্টপ, নিউজস্ট্যান্ড থাকে, থাকে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা, অন্তত প্রখর রোদ বা বৃষ্টিতে একটু মাথার ওপরে ছাদ। এত উন্নয়ন কি মানুষকে স্বস্তি দেবে? যদি এ শহরে পত্রিকা কেনার স্থান না থাকে! না থাকে নতুন কোন পাঠকের জন্য নতুন কোন বই বিক্রেতা? মোস্তফা ভাইদের জায়গা দিতে না পারলে ১৯৯ টাকায় দুই বার্গারের শহরে মানুষের ওজন বাড়বে, জ্ঞান বুদ্ধি বাড়বে না। এ কেমন শহর যেখানে মিরপুর রোডে কোন বাসস্টপে ছায়া নেই, পানি নেই, পত্রিকা নেই, বই নেই! এ শহর কি মানুষের?’ ছুটির সন্ধ্যায় কবি-সান্নিধ্যে আয়োজনটি বেশ। একজন কবিকে কেন্দ্র করে সমগ্র অনুষ্ঠান। কবি গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা শোনাবেন, আনুষ্ঠানিকভাবে মঞ্চে এসে একজন কবিকে প্রশ্ন করবেন। কবিসমীপে প্রশ্ন তুলে ধরতে পারবেন যে কোন দর্শক-শ্রোতাও। আর কবিকে নিয়ে বলবেন তার সতীর্থরা। একজন কবিকে কেন্দ্রে রেখে এমন ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজক ঐহিক। আর এবারের কবি ছিলেন আশির দশকের বিশিষ্ট কবি জুয়েল মাজহার, মাত্র তিনখানা কাব্য নিয়ে যিনি ঋদ্ধ পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাই দীপনপুরে অনুষ্ঠানস্থলে একটি আসনও শূন্য ছিল না। তিনটি পর্বে সাজানো কবি ও পাঠককুলের এই আয়োজনের প্রথম পর্বে জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ও মুহূর্তের কথা তুলে ধরেন কবি। এ সময় কবি বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছরের মতো হলো কবিতা লিখছি। কিন্তু সেগুলো কবিতা হতে পেরেছে কি-না, তা আমি জানি না। কবিতা লেখার মতো পড়াশোনাও আমার করা হয়নি। তবে আমার জীবনের একটা বড় অর্জন আছে। তা হলো অনেক মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে; খুব সাধারণ সব মানুষ। কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে পেয়েছেন উল্লেখ করে কবি বলেন, মানুষ ও প্রকৃতির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেখান থেকেই আমি অনুপ্রেরণা পাই। হিমালয়চূড়া এভারেস্টজয়ী তেনজিং নোরগে, অলিম্পিকে খালি পায়ে ম্যারাথন রেসে জেতা ইথিওপিয়ার আবিবি বিকিলা, বাংলার কবি আল মাহমুদ-শামসুর রাহমান থেকে আমার কবিতা অনুপ্রাণিত। আর দক্ষিণ ভারতের ঔপন্যাসিক আর কে নারায়ণের পরোক্ষ প্রেরণা আছে। নিজের জেদের ঘোড়ায় চড়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করি। কবি জুয়েল মাজহার একে একে পাঠ করেন ‘ক্রমহননের পথ’, ‘দশ পায়ে নাচি’, ‘চান্নিপশর রাইতের লৌড়, ‘শীতের দৈত্য’, ‘রুবিকন’ এবং ‘গোলাপের জন্ম’। এ ছাড়াও উপস্থিত অতিথিদের অনুরোধে কবি পাঠ করেন তাঁর পাঠকপ্রিয় কবিতা ‘দিওয়ানা জিকির’। ঐহিক-এর সম্পাদক মেঘ অদিতি বলেন, প্রতি মাসেই আমরা নিয়মিতভাবে একবার এমন সাহিত্য সমাবেশের আয়োজন করি। এমন আয়োজনে আমরা কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আড্ডা ও আলাপচারিতা করতে চাই। কবির জীবন, দীর্ঘ সাহচর্য ও কবিতার ওপর আলোচনা করেন দুই কবি সরকার মাসুদ ও চঞ্চল আশরাফ। সম্পূর্ণ নিজস্ব আজ নির্বাচিত ফেসবুক পোস্ট হিসেবে তুলে দিচ্ছি আমার এককালের সহকর্মী সাংবাদিক হাসান মামুনের লেখা। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি মতিঝিলে একটি মিডিয়ায় কাজ করতাম। দুপুরে কয়েক মিনিট হেঁটে চলে যেতাম মোড়ের দেশবন্ধু রেস্টুরেন্টে। সেখানকার পরোটা-ভাজি ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারে পরিণত হয়েছে, তার একটি উদাহরণও এই ছোট্ট লেখায় রয়েছে। তিনি লিখেছেন- ‘ইত্তেফাক এখন আর সেখানে নেই, তবু রিক্সাওয়ালা ভাইকে বললাম- ইত্তেফাক মোড়ে চলো। সেখানে নতুন ধারার মিষ্টির ব্যবসা ‘রস’-এর একটা শাখা রয়েছে। ওখান থেকে দেখেশুনে নিলাম কাঁচা ছানার সন্দেশ আর ওদের স্পেশাল দই। দাম কেজি ৫৯০ ও ৩৪০ টাকা। অতঃপর যা হয় ওখানটায় গেলে, তাই হলো। রাস্তার উল্টোপাশে গিয়ে অনুজ্জ্বল ‘দেশবন্ধু’ থেকে নিলাম ওদের বিখ্যাত সবজি আর পরোটা- পরে ওভেনে গরম করে খাওয়া যাবে বলে। দেশবন্ধুর ক্যাশে বসা দাদাসহ দু’জন ওয়েটারও দেখি পরিচিত। একজন জানতে চাইলেন, রস থেকে কী নিলাম। দামটামও বললাম তাকে। শুনে বললেন, আমাগো গুড়ের সন্দেশ তো খাইছেন? দাম ৪৬০ টাকা কেজি। কোন্ অংশে খারাপ? আর দই লইয়া যান- ২২০ টাকা কইরা।’ তার পরই তিনি বললেন, ওগো খরচা অবশ্য বেশি। দোকান এসি করা, কর্মচারীগো বেতন বেশি, গাড়ি দিয়া মাল আনে, হেইডাও মনে করেন এসি করা; ওগো কারখানাও নাকি হাইফাই। দেখলাম, লোকটির মধ্যে নতুন ধারার ব্যবসা বুঝে ওঠার একটা চেষ্টা আছে। বললাম, এসব দেখে মন খারাপ হয়? তিনি হেসে বললেন, মন খারাপ অইব কে? ওগো ব্যবসা ওরা করে; আমাগোডা আমরা। এই যে আপনে ভাজি-পরোটা নিবার আমাগো কাছেই তো আইছেন! এইডা অইলো আমাগো ব্যবসা। এইডা ওরা নিবার পারবো না, বুঝছেন?’ প্রতিদিন অনিবার্য রুমাল এপ্রিল থেকেই শুরু হয়ে যায় এই খণ্ড কালীন বিকিকিনি- প্রধানত রুমালই উপকরণ। তবে অধুনা যুক্ত হয়েছে কানে বাঁধার মাস্ক, ধুলার আগ্রাসন থেকে রেহাই পেতে। অবশ্য লেবুর শরবতও বিক্রি হয় এই সময়টায় খুব বেশি। মোড়ে মোড়ে টেবিলে পেতে লেবু চিপে শরবত বানানোর কাজ চলে। এবার দেখলাম রাস্তার পাশে মিশ্র শরবতও বিক্রি হচ্ছে সুলভে। মিশ্র মানে বেলের সঙ্গে লেবু মেশানো, বা তরমুজের সঙ্গে আরেকটা আইটেম মিশিয়ে পানীয় তৈরি। খেতে কেমন স্বাদ জানিনে, তবে মানুষর স্বভাবই হলো নতুন কিছু ব্যতিক্রম কিছু তার চাই। যাহোক, আজ বলব রুমালবিক্রেতার কথা। বিমানবন্দর সড়ক ধরে বনানী পার হওয়ার সময় বাঁপাশে খোলা মাঠের ভেতর লোকটিকে রুমাল বিক্রি করতে দেখি। সিমেন্টের পিলারের ভগ্নাংশকে চেয়ার বানিয়ে এক হাতে ছাতি ধরে রেখে অন্যহাতে ডুগডুগি বাজিয়ে ক্রেতা আকর্ষণ করেন। ছাতির শলাকাগুলোতেই ঝোলানো থাকে রুমাল ও মাস্ক। রুমালগুলো রং-বেরঙের। মানুষ আজকাল অবশ্য কাপড়ের নয়ং কাগজের রুমাল মানে টিস্যুকেই বেছে নেয় বেশি। তাতে ঘাম শুষে নেয়। ব্যবহার করে ফেলে দেয়া যায়, ধোয়াধুয়ির ঝক্কি নেই। তবে ঢাকায় হরেক রকম মানুষের বাস। কেউ কেউ নিশ্চয়ই দশ টাকা দিয়ে রুমাল কেনেন তা না হলে এই বিক্রেতা চৈত্রের আগুনগোলা মাথার ওপরে নিয়ে দিনভর ডুগডুগি বাজাবেন কেন? ৭ এপ্রিল ২০১৯ [email protected]
×