ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ বছর আগে দুই হাজারের বেশি মামলা দায়ের;###;তদন্ত শেষে এক হাজার মামলার চার্জশীট দেয়া হয়েছে

ওরা এখনও ধরা পড়েনি ॥ জামায়াত বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাস

প্রকাশিত: ১০:২৮, ৭ এপ্রিল ২০১৯

ওরা এখনও ধরা পড়েনি ॥ জামায়াত বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাস

শংকর কুমার দে ॥ বিএনপি-জামায়াতের ডাকে হরতালের নামে সহিংস সন্ত্রাস, পেট্রোলবোমা, আগুন সন্ত্রাস, নাশকতার ঘটনায় অকালে ঝরে গেছে অনেক প্রাণ। আহত হয়েছেন অনেকে। এমন নৃশংস ঘটনায় নিহতের পরিবারের পাশাপাশি আহতরা গত পাঁচ বছরে যেমন বিচার পাননি, তেমনি আসামিদেরও বিচার হয়নি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে প্রায় এক হাজার মামলা পাঁচ বছর ধরে তদন্তাধীন। সারাদেশে আগুন সন্ত্রাস ও নাশকতার অভিযোগে পাঁচ বছর আগে দুই হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার মামলার তদন্ত শেষ করে চার্জশীট প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু আরও যে সহস্রাধিক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে গত পাঁচ বছরেও এসব মামলার তদন্ত শেষ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়া সম্ভবপর হয়নি। গ্রেফতার হয়নি বহু আসামি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে নির্বাচন পূর্ব থেকে ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ডাকে পেট্রোলবোমা হামলা ও নাশকতার ঘটনায় দেশব্যাপী দুই হাজারের বেশি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে পেট্রোলবোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ, নাশকতাসহ সহিংসতার ঘটনায় ১ হাজার মামলার চার্জশীট দেয়া হয়েছে। ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে সারাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা হরতাল-অবরোধের নামে পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও সংঘটিত নাশকতা মামলাগুলোর তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের ঘটনা চলছে অত্যন্ত শম্বুক গতিতে। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে এসব মামলার ঘটনার হোতারা। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানা গেছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নাশকতার ঘটনাগুলোর মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৩ সালের শেষভাগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন হরতাল-অবরোধে নাশকতায় বহু মানুষ হতাহত হয়েছিল। নির্বাচন-পূর্ব পেট্রোলবোমার সহিংসতায় ২৫ দিনে পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগে ১৩৩ জন দগ্ধ হয়েছেন, নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এ ছাড়া বিভিন্ন সহিংসতায় ৩৮২টি বাস-ট্রাকে আগুন, রেলে নাশকতামূলক ১৪টি ঘটনায় দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত এবং তিনটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আহত এবং পুলিশের ওপর ৮৫টি আক্রমণের ঘটনা ঘটে বলে পুলিশের পরিসংখ্যানে উল্লেখ আছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের টানা ৯৩ দিনের অবরোধে সারাদেশে ব্যাপক নাশকতা চালানো হয়। সারাদেশে পেট্রোলবোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, বাসে আগুন ও পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। তখন সারাদেশে নারী ও শিশুসহ অন্তত ৯৫ জনের মৃত্যু হয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ৬৪ জন। দগ্ধ ও আহত হয়েছেন আরও এক হাজার ৪১৩ জন। আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেট্রোলবোমার দগ্ধ মুখ নিয়ে বন্দী জীবনযাপন করছেন তারা। মুখের আকৃতি পরিবর্তন হওয়ায় নিজের সন্তানও কাছে আসে না। এমন অসহনীয় জীবন তারা চান না। ক্ষমতার জন্য যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে তাদের ধিক্কার জানিয়ে এমন রাজনীতি পরিহার করারও অনুরোধ করেছে তাদের অনেকে। বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের সময় নাশকতায় দায়েরকৃত অধিকাংশ মামলার তদন্ত চলছে ধীরগতিতে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে নাশকতার অভিযোগে ১ হাজার ৭৭৫টি মামলা দায়ের করা হয়। আসামির তালিকায় রয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতাসহ মাঠ পর্যায়ের কয়েক হাজার কর্মী। এর মধ্যে যানবাহনে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মানুষ হত্যার অন্তত চারটি ঘটনায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুর এলাকায় গভীর রাতে কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা আইকন পরিবহনের একটি বাসে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে আট যাত্রী নিহত হন। চৌদ্দগ্রাম থানার পুলিশের এক এসআই বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা দুটি দায়ের করেন। মামলায় ৫৬ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ২০ জনের কথা বলা হয়। একটি মামলায় উস্কানিদাতা হিসেবে আসামি করা হয় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে। এসব মামলায় যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের অনেকে এখন জামিনে রয়েছেন। গাইবান্ধার তুলসীঘাট এলাকায় নিপু পরিবহন নামে একটি বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় আট যাত্রী নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এ মামলা হয় স্থানীয় থানায়। মামলার প্রধান আসামি মোস্তফা মঞ্জিল গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে গ্লোরি পরিবহনে পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এ সময় বাসের ভেতর ২৯ যাত্রী দগ্ধ হন, মারা যান একজন। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় এক এসআই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি যাত্রাবাড়ী থানা থেকে ডিবিতে স্থানান্তর হয়। এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপির আরও ৩৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এলাকায় দায়ের করা ৪৫৭টি নাশকতা মামলার মধ্যে তিন শতাধিক মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পাঁচ বছর আগের দায়ের করা মামলাগুলোর ঘটনায় যারা হোতা তাদের এখনও বিচার হয়নি। এমনকি মূল হোতাদের অনেকেই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। নাশকতা ও পেট্রোলবোমার মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার এবং তদন্তে অবহেলার কারণেই তদন্ত শেষ করে চার্জশীট দাখিল হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে তখনকার ঘটনার মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। দেরিতে হলেও অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে পেট্রোলবোমার মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পেট্রোলবোমার সঙ্গে অগ্নিসংযোগ ও নাশকতাসহ অন্যান্য ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্নসহ আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশে হরতাল ডেকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ, বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো ও নাশকতা চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো গত দুই বছরেও তদন্ত শেষ না হওয়া এবং আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ ও হরতালে অগ্নিসংযোগ, নাশকতা ছাড়াও শুধু পেট্রোলবোমা হামলা সংক্রান্ত মামলা হয়েছে প্রায় ৫শটির মতো। এর মধ্যে চার্জশীট দেয়া হয়েছে মাত্র অর্ধশতটি। দেশব্যাপী ওই সময়ে সব ধরনের নাশকতার ঘটনায় ১ হাজার ৭১৭টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে মাত্র ৫২টি মামলার তদন্ত শেষে চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসের দায়েরকৃত মামলায় প্রায় ১৬ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে দুই সহ¯্রাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে এজাহারে। এই সময়ের মধ্যে রেলপথে ৩৫ ও নৌপথে ছয়টি নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। আর সারাদেশে দুই হাজার ২৮৬টি ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসের নাশকতায় বোমা হামলায় মারা গেছেন ৫২ জন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ২৮১ জন। ককটেল ও অন্যান্য কারণে আহত হয়েছেন ৫৪৯ জন। অন্যভাবে নিহত ২১ জন। তবে বিভিন্ন সূত্রের খবরে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিন মাসে ১৩৮ জন মারা গেছেন, যাদের ৭৭ জনই পেট্রোলবোমার আগুনে নিহত। আহত হয়েছেন অন্তত ৮৩০ জন। পেট্রোলবোমায় যারা নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক ও বাসের যাত্রী। মাগুরার মঘিররঢাল এলাকায় বালুবাহী ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে সাতজন মারা যান। এ ঘটনায় জামায়াতের এক নেতা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ডাকা পাঁচ বছর আগের হরতালের নামে পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও নাশকতার মামলাগুলোর মধ্যে যেসব মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় যারা আসামি আছে তাদেরও গ্রেফতার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। হরতালের নামে রাজনৈতিক কর্মসূচী দিয়ে দেশব্যাপী পেট্রোলবোমার সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন, আসামিদের গ্রেফতার ও বিচার না হওয়ার কারণে নিহতের পরিবার ও আহত ব্যক্তিরাও বিচার পাননি বলে স্বীকার করেছেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
×