ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ত্রাণের আশায় পরিচয় বদলে রোহিঙ্গা সাজছে বাঙালীরা!

প্রকাশিত: ১০:১৬, ৬ এপ্রিল ২০১৯

 ত্রাণের আশায় পরিচয় বদলে রোহিঙ্গা সাজছে বাঙালীরা!

বাংলাট্রিবিউন ॥ রোহিঙ্গারা জালিয়াতি করে বাংলাদেশী পরিচয়পত্র-পাসপোর্ট জোগাড় করছে, এই অভিযোগ বহু পুরনো। কিন্তু এখন বাংলাদেশী নাগরিকরাও রোহিঙ্গা সেজে রোহিঙ্গা ডাটাবেজে নাম তুলছেন। মূলত ত্রাণের আশায় নিজের নাম ও পরিচয় বদলে এবং অন্যের সন্তানকে নিজের দাবি করে রোহিঙ্গা তালিকায় নাম তুলেছেন কিছু বাঙালী। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শরণার্থী অধ্যুষিত কক্সবাজারে উখিয়া-টেকনাফে ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পাওয়ার আশায় রোহিঙ্গা সেজেছেন কমপক্ষে পাঁচ শ’ বাংলাদেশী। তারা ত্রাণের লোভে স্থানীয় বাসিন্দা পরিচয় গোপন রেখে রোহিঙ্গা তালিকায় নাম তুলেছেন। টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে নিয়মিত ত্রাণও নিচ্ছেন তারা। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণকারী রোহিঙ্গা নেতারা টাকার বিনিময়ে তাদের এ পরিচয়পত্র পেতে সহযোগিতা করছেন। উল্লেখ্য, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধন থেকে বাঁচতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহ নানা সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। এ সহায়তা পেতেই স্থানীয় বাঙালীরা রোহিঙ্গা সাজছেন বলে জানা গেছে। টেকনাফ উপজেলার লেদা, নয়াপাড়া, শামলাপুর ও উখিয়ার শিবিরের রোহিঙ্গা নেতাদের দেয়া এ তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন খোদ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘বাঙালীদের রোহিঙ্গা সাজার বিষয়টি খতিয়ে দেখে তাদের কার্ড বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ২২শ’ পরিবারের ১৩ হাজার রোহিঙ্গা টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করছেন। এ শিবিরটির অবস্থান টেকনাফ থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে মেরিন ড্রাইভ সড়কের কাছাকাছি। তবে ২৩ নম্বর এই শিবিরটির সঙ্গে অন্য শিবিরের তফাত হলো, এখানে বাঙালী আর রোহিঙ্গা একই গ্রামে থাকে। এই শিবিরের পাশে অবস্থিত নয়াপাড়া শিলখালী একটি গ্রাম। সেখানে ১নং ওয়ার্ডে টিনশেড ইটের ঘরে বসবাস করছেন এক বাঙালী নারী। তাদের আর্থিক অবস্থা বেশ ভাল। এই নারী একদিকে ভোট প্রয়োগ করছে, অন্যদিকে শরণার্থী হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছে। বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্রে দেয়া তথ্য অনুযায়ী তার নাম ছেনুয়ারা বেগম, বয়স ৪০। স্বামী আবদুল হক। পরিচয় নম্বর ২২১৯৭৬৫৯৫৫০৭। আবার বিশ্ব খাদ্য সংস্থার রোহিঙ্গাদের ডাটাবেজে তিনিই রহিমা। স্বামী করিম উল্লাহ। শুধু তাই নয়, অন্য দুজনের দুই বাংলাদেশী শিশু সন্তানকে নিজের সন্তান বানিয়ে রোহিঙ্গা ডাটাবেজ করেন এই নারী। তাদেরও দুই দেশের পরিচয়, দুটি নাম রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে আহমদ (১০), রোহিঙ্গা কার্ডে রেদোয়ান এবং ফাতেমা আক্তার (৯), রোহিঙ্গা কার্ডে রেহেনা বেগম। তবে তাদের আসল পরিবার রোহিঙ্গা বানানোর খবর পাওয়ার পরে জোর প্রতিবাদ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছে। তাদের মতে, ছেনুয়ারা বেগমই শুধু নয়, এই রোহিঙ্গা শিবিরে শতাধিক বাঙালী একইভাবে রোহিঙ্গা সেজেছে। অভিযুক্ত ছেনুয়ারা বেগমের উত্তর থমকে যাওয়ার মতো। নিজেকে মিয়ানমারের নাগরিক পরিচয় দিয়ে বিশ্ব আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থা কার্ড বের করে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক পুরনো রোহিঙ্গা। ত্রাণের মাধ্যমে কোন রকম সংসার চলে। আমি তো বাংলাদেশী না। তাই কোন কাজকর্ম করতে পারি না।’ আসলেই তিনি রোহিঙ্গা কি না জানতে চাইলে আর কথা বলতে রাজি হননি। এই নারীর স্বামী আবদুল হক প্রথমে তার স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগম মানসিক রোগী বলে দাবি করেন। পরে আবার সব স্বীকার করে দোষ চাপিয়ে দেন স্ত্রীর ওপর। দাবি করেন তার স্ত্রী লোভের কারণে ও শুধু ত্রাণের আসায় বাঙালী থেকে রোহিঙ্গা সেজেছে। বিষয়টি তিনি জানতেন না। আরেক লোকের সন্তানকে নিজের সন্তান বানিয়ে রোহিঙ্গা কার্ডে নাম তুলেছে বলে এক লোক অভিযোগ করার পর তিনি বিষয়টি জেনেছেন। আবদুল হক বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করবেন না। কারণ এরই মধ্যে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবারে খুব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’ স্থানীয় ও রোহিঙ্গা শিবিরের নেতারা বলেন, এই রোহিঙ্গা শিবিরে কোন ধরনের সমস্যা নেই বললেই চলে। তবে শিবিরটি গ্রামের সঙ্গে লাগোয়া হওয়ায় বাঙালীরা অনেক সময় রোহিঙ্গা সাজার চেষ্টা করে। এতে কিছু রোহিঙ্গা টাকার বিনিময়ে তাদের সহযোগিতাও করেছে। শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আবুল কালাম জানান, তার শিবিরে অর্ধশতাধিকের বেশি বাঙালী রোহিঙ্গা সেজেছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। পুরো রোহিঙ্গা শিবিরের হিসাব করলে এই সংখ্যা দুই শতাধিক হবে।
×