শাহীন রহমান ॥ বুড়িগঙ্গাসহ সারাদেশে নদী রক্ষায় এবার জিরো টলারেন্স নীতি নেয়া হয়েছে। এই লক্ষ্যে গত ২৯ জানুয়ারি থেকে বুড়িগঙ্গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে বিআইডব্লিটিএ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন নদীর সব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে অচিরেই নদীর ওপর মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে লাগাতার উচ্ছেদ চলছে। গত ১৩ দিনে নদীর পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দেড় হাজার স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান, নদী দখলমুক্ত করতে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে এবারের অভিযান চালানো হচ্ছে। নদী দখলমুক্ত না করা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।
প্রতিষ্ঠানটির যুগ্মপরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, নদীর দুই ধার দিয়ে ৫০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৩ কার্যদিবসে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান শেষে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন ইতোমধ্যে ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য নক্সা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে নক্সা হয়ে গেলে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন, এবারের উচ্ছেদে ব্যতিক্রম ঘটনা হলো ফাউন্ডেশনসহ নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, কামরাঙ্গীরচর, ছাতামসজিদ, বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল, কিল্লার মোড়, শ্মশান ঘাট এলাকার সব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে তোলা টিনের ঘর, আধাপাকা, পাকা বহুতল ভবন, বিভিন্ন স’ মিল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এমনকি সরকারী প্রতিষ্ঠানের স্থাপনাও গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনাকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। অভিযানকালে নদীর তীর, জায়গা দখল ও ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগে আটক ও জরিমানার ঘটনা ঘটেছে। অভিযানে বহুতল ভবন পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বুলডোজার দিয়ে অনেক অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রভাবশালী কোন মহলের তদবির আমলে নেয়া হচ্ছে না।
বুড়িগঙ্গার তীর দখলমুক্ত করার ধারাবাহিক অভিযানের অংশ হিসেবে গত ১৩ দিন ধরে এই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত। উচ্ছেদে প্রভাবশালী কারও তদবির আমলে নেয়া হচ্ছে না। অনেক দখলদার উচ্ছেদে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এমনকি বুড়িগঙ্গার তীরে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজলের শ্বশুরের ভবনও।
বিআইডব্লিউটিয়ের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন আরও বলেন, উচ্ছেদ সম্পন্ন হওয়ার পরে ওয়াকওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি জাহাজের পণ্য ওঠানামানোর জন্য জেটি নির্মাণ করা হবে। বালু ব্যবসায়ীরা যাতে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন করতে না পারে এবং অবৈধভাবে ব্যবসা না করতে পারে এ কারণেই জেটি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। উচ্ছেদ অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মুস্তাফিজুর রহমান বলেন ঢাকার চারপাশের নদী দখলমুক্ত করতে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে। এ জন্যই এই অভিযান। এখন থেকে এটা অব্যাহত থাকবে। কেউ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও কোন কাজ হবে না।
২০০৯ সালে ঢাকার চার নদী রক্ষায় হাইকোর্ট যুগান্তকারী রায় দিলেও আজ পর্যন্ত নদী রক্ষায় তেমন কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সাধারণ জনগণ এবং পরিবেশবাদীরা নাখোশ ছিল। ওই রায়ের পড়ে অনেকবার চার নদীতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের বাধার মুখে সেসব অভিযান থমকে যায়। বারবার উচ্ছেদ করা হলেও তা পুনরায় দখলের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দখল রোধে তেমন কার্যকর কোন উদ্যোগ এর আগে লক্ষ্য করা যায়নি। তবে বিআইডব্লিটিএর কর্মকর্তারা বলছেন এবারের উচ্ছেদ ব্যতিক্রম হচ্ছে। কোন প্রভাবশালীর আবদার রক্ষা করা হচ্ছে না। কোন প্রভাবশালী এই উচ্ছেদ অভিযানে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। উচ্ছেদ অভিযান শেষে নদীর রক্ষায় যে মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন শুরু হলে পুনরায় দখলকারীরা দখল করতে সাহস পাবে না।
উচ্ছেদ অভিযানে কামরাঙ্গীরচরের ঝাউচরে একটি তিনতলা ভবন উচ্ছেদের প্রস্তুতির সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল কাগজপত্র দেখিয়ে সেটাকে বৈধ হিসেবে দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত ওই ভবন গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। মোশারফ হোসেন কাজল দাবি করেন ১৯৬১ সালে ওই সম্পত্তি কিনেছেন তার শ্বশুর জানে আলম। নদীর নির্ধারিত সীমানা প্রাচীর থেকে ওই জমি ৩০ ফুট বাইরে। সিএস, আরএস, নগর ও সিটি কর্পোরেশন জরিপেও এ জমি তার শ্বশুরের নামে রয়েছে। নদীর সীমানা পিলারের বাইরে গিয়ে বৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। তবে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান নদী ভরাট করেই ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এটা অবৈধ। পরে সেটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।
উচ্ছেদ অভিযানের সময় অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি দখলদারদের কাছ থেকে তীরভূমিও উদ্ধার করা হচ্ছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা। এর আগে আদালতের আদেশে চার নদীতে সীমানা পিলার নির্মাণ করা হলেও ওই সময় তা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়। অভিযোগ ওঠে সীমানা পিলার স্থাপন করে দখলদারদের নদীর দখলে বৈধতা দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ সীমানা পিলার শুষ্ক মৌসুমের নদী প্রবাহের পাশে স্থাপনা করা হয়। অথচ পরিবেশবাদীরা বলেন বর্ষার সময় নদীর প্রবাহ এবং শুষ্ক মৌসুমের মাঝামাঝি স্থান হলো নদীর তীর বা বেলা ভূমির স্থান। এই অংশের মধ্যে কারও নামে বৈধ দখলদারি থাকতে পারে না। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিআইডব্লিটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, সীমান পিলার নিয়ে যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে তা নিরসনে একটি কমিটির গঠন করা হয়েছে। কমিটির যে সিদ্ধান্ত দেবে যে অনুযায়ী পুনরায় নদীর সীমানা রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: