ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় ঐক্য- এখন সময়ের দাবি

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 জাতীয় ঐক্য- এখন সময়ের দাবি

গত ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক ঘটনার সাক্ষী ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয়োৎসব উপলক্ষে আয়োজিত বিশাল সমাবেশে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাষণে ‘ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষসহ দলমত নির্বিশেষে পুরো দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, আসুন সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি, দেশের মানুষ যে আস্থা-বিশ্বাস রেখেছে, প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে হলেও জনগণের সেই আস্থা-বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করব।’ গত ২৫ জানুয়ারি ২০১৯ সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে বলেছেন, এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে দলমত নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিক সমান। তিনি দলমত নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের সমর্থন ও সহযোগিতা রেখেছেন। তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সংখ্যা যত কমই হোক, সংসদে যে কোন সদস্যের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রস্তাব, আলোচনা-সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি থাকবে না। তিনি আরও বলেছেন, সরকারী সেবা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করব। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতির উচ্ছেদ করা হবে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর দুটো ভাষণকেই অভিনন্দন, শুভেচ্ছা জানিয়েছে। দেশের মানুষ বরাবরই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সদিচ্ছার প্রতি আস্থা রেখেছে। তাঁর প্রশ্নাতীত দেশপ্রেম, সততা, সদিচ্ছা এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের সংকল্প সব সময়ই বিদ্যমান। সময়, সুযোগ, পরিবেশ, বাস্তবতা সব সময়ই অনুকূল হয়নি। গত ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, বুধবার একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে সকলের ঐকমত্য গড়ে তোলার। তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ পেতে পারে না। গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সুমন্নত ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল রাখতে দেশ থেকে সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ সম্পূর্ণরূপে নির্মূলের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে বাঙালী জাতিকে আরও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য নিরাপদ কর্মচঞ্চল, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সকলের কাম্য। বাংলাদেশের জাতীয়ভাবে লক্ষ্য, আদর্শ, যাত্রাপথ এবং সর্বোপরি জাতীয় রাজনীতি সুস্পষ্ট করার আরেকটি সুযোগ দ্বারপ্রান্তে। আমরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে সুযোগ পেয়েছিলাম তা হারিয়েছিলাম ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে জাতীয়Ñ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে, সুযোগ পেয়েছিলাম ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর, সুযোগ পেয়েছিলাম ২০০৮-এর নির্বাচনের পর, এখন আরেকটি সুযোগ দেশবাসীর সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। ’৭২ থেকেই অনেকটা অস্থিরতার মধ্যে চলেছে দেশ এবং রাজনীতি। নির্বাচন ২০১৮ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হওয়ায় নির্বাচন পরবর্তী পরিবেশ এবং সময় অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে স্বস্তিকর এবং শান্তিপূর্র্ণ। এখন দেশের সকল রাজনৈতিক নেতা এবং দলকে দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক রাজনীতি বিবেচনায় রেখে গণমুখী রাজনীতির চর্চা করতে হবে। স্বীকার করে নিতে হবে দেশের মানুষ অনেকটাই রাজনীতিবিমুখ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম অনেক বাস্তববমুখী এবং হিসেবী। বিশ্ব বাস্তবতায় এখন বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাও ক্যারিয়ারমুখী, অযথা সময় নষ্ট করতে প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে, আধুনিক জীবন-যাপনের জন্য। এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ, পেছনে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন, দেশের উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার যে আহ্বান জানিয়েছেন তাতে দেশের সকল মানুষকে সাড়া দেয়া উচিত। তাঁরা ঐক্যের যে ভিত্তির কথা বলেছেন তাতে কোন দেশপ্রেমিক মানুষের নীরব থাকার সুযোগ নেই। দেশের মানুষ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর আর কোন অনৈক্য দেখতে প্রস্তুত হয়। জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের দাবি দেশের প্রয়োজনে, দেশবাসীর কল্যাণের জন্য। দেশের মানুষ বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে, আলোচনা-পর্যালোচনায় দেশের কল্যাণে নানা অভিমত তুলে ধরেছেন। সব রাজনৈতিক দলই সব সময় তা আমলে নেয়নি। জাতির এক নবযুগসন্ধিক্ষণে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই দেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে - ১. রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলকে সকল পরিস্থিতিতে উর্ধে তুলে রাখতে হবে। ২. বাংলাদেশের রাজনীতি হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর। স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশে রাজনীতির অধিকার থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের- বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃতকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নই হবে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির মূল ভিত্তি। ৩. বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত করে এমন সকল কর্মসূচী বর্জন করতে হবে। ৪. মহান জাতীয় সংসদ হবে রাজনীতি এবং জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের মূল কেন্দ্র। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংসদ বর্জনের অধিকার আইন করে রহিত করতে হবে। সকল সংসদ সদস্যের সংসদে উপস্থিতি এবং ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। ৫. সরকারকে সকল নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকার পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মতামত এবং সম্পৃক্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেবল ভোট প্রদানই জনসম্পৃক্তি নয়, সরকার পরিচালনার সকল স্তরে যুক্ত করতে হবে। ৬. শিশু, মহিলা, শ্রমজীবী মানুষসহ সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে সামাজিক অপরাধ প্রতিহত করে সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে হবে। ৮. কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যানজট নিরসন, নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। ৯. কঠোরভাবে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হবে। ১০. তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন, ইচ্ছা ধারণ করে কর্মসংস্থান, সুযোগ এবং পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। ১১. দেশে সুস্থ, গঠনমূলক, ষড়যন্ত্রমুক্ত রাজনৈতিক ধারার সংস্কৃতি সৃষ্টিতে সকল রাজনৈতিক দলকে দেশবাসীর কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের নিজস্ব মতবাদের পর এই ১১ দফা নীতি গ্রহণ দেশ ও জনকল্যাণের জন্য জরুরী। দেশের মানুষ আশা করে রাজনৈতিক দলগুলো জনকল্যাণভিত্তিক কর্মসূচীর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা এবং আস্থা অর্জন করবে। বৈশ্বিক রাজনীতিরও হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব রাজনীতি ছিল অনেকটা আদর্শভিত্তিক, আর এখন হয়েছে অর্থনীতিভিত্তিক। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারসাম্য এবং সঠিক কৌশল অনুসরণ করে এখন জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব- বাংলাদেশ যেখানে বড় উদাহরণ। দেশের মানুষ দেশের শান্তি, উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও জাতীয় ঐক্য গড়ার এ সুযোগটা হাতছাড়া করতে প্রস্তুত নয়। বঙ্গবন্ধুর পর বঙ্গন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাই হচ্ছেন সেই নেতা যিনি জাতীয় ঐক্যের নেতৃত্ব দিতে পারেন। দেশের প্রয়োজনে, কল্যাণে বঙ্গবন্ধুকন্যা যে কোন পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করেননি এবং করবেন না। দেশবাসী মনে করে গণতান্ত্রিক চর্চা হবে সংসদে, সংসদের বাইরে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন হবে রাজপথে। জাতীয় ঐক্যের এ সুবর্ণ সুযোগ কোন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল উপেক্ষা করবে না- দেশের জনগণের এটাই প্রত্যাশা। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×