ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

যাত্রা হলো শুরু ওহে কর্ণধার

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৭ জানুয়ারি ২০১৯

 যাত্রা হলো শুরু ওহে কর্ণধার

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনেছেন এই বাংলায় তিনি। এমনিতে খুব অল্প মানুষ শুনতে পান কালের যাত্রার ধ্বনি। কালের যাত্রা পথের প্রতিটি বাঁক যার নখদর্পণে, মহাকালের প্রেক্ষাপটে যারা যাচাই করতে পারেন খ-কালকে, যথাযোগ্য যুক্তি এবং বিদগ্ধ বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেন মানবসভ্যতা তথা জাতীয় সভ্যতার যাবতীয় অর্জন আর স্খলনের, প্রাপ্তি আর প্রাপ্তির প্রকৃত চেহারাটিকে। তিনি তাদেরই একজন। তার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও/তারই রথ নিত্যই উধাও।’ মেধা-মনন, প্রজ্ঞা, কর্মকুশলতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতা, সত্যনিষ্ঠতা তাকে সময়ের চেয়ে প্রাগ্রসর স্থানে ঠাঁই করে দিয়েছে। তাই উদার আকাশ আর বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাতে পারেন, ‘বাংলার মানুষের ভাগ্য গড়াই আমার একমাত্র চাওয়া-পাওয়া। আসুন, সকলে মিলে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাই।’ এমন আবেদন বা আহ্বান তিনিই পারেন জানাতে। কারণ, তিনি নিজেকে যে অবস্থানে উন্নীত করেছেন, হয়েছেন বাঙালী জাতিসত্তাকে উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়ার কা-ারি, তার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হতে পারে এমনই বাণী। তাই নবনির্বাচিত দলীয় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন এই বলে যে, ক্ষমতাকে ব্যক্তিগত সম্পদ বানানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। তাই ক্ষমতাকে কেউ নিজের সম্পদ মনে করবেন না। এটা তো বাস্তব এবং সত্য যে, দেশপ্রেম না থাকলে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ থাকতে পারে না। কিন্তু তিনি তো জাতির পিতার কন্যা। আর এখানেই তার গৌরব এবং গর্ববোধ অমলিন। বলেছেনও, ‘প্রধানমন্ত্রী পদটাকে কিভাবে উপভোগ করব, সেই চিন্তা করি না, মানুষের কল্যাণে নিজেকে কতটুকু নিয়োজিত করতে পারতাম আমার কাছে সেটাই বিবেচ্য। আসলেই তাই, নিজের জীবনকে সমর্পিত করেছেন বাংলার মানুষের জন্য। তাই জীবন-মৃত্যুকে করেছেন পায়ের ভৃত্য। একুশবারের বেশি হত্যা চেষ্টার শিকার বিশ্বের আর কোন রাজনীতিক বা রাষ্ট্রনায়ক অতীত বা বর্তমানে হয়েছেন, এমন নিদর্শন নেই। সেসব তুচ্ছ করে বাংলার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যেভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন দেশকে, তাতে জাতির জীবনে নতুন অধ্যায় সূচিত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি আর দলের শুধু নন, সারা বাংলার মানুষের। এদেশের প্রতিটি মানুষেরই তিনি নেতা। তার হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তাই দলীয় এমপিদের অবলীলায় নির্দেশ দিতে পেরেছেন এই বলে যে, ‘কে নৌকায় ভোট দিল, কে দিল না, সেটা বিবেচ্য নয়। আমরা সবার উন্নয়ন করব।’ তিনি যা বিশ্বাস করেন, তাই বলেন। যে কারণে ভিন্নমতাবলম্বী বা জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) নেতা-নেত্রী শিল্পীদের চিকিৎসাসহ সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছেন সব সময়। এমনকি যে চিত্র পরিচালক, অভিনেতারা পঁচাত্তরের পরে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তা শাসক জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে ঢাকার সিনেমা থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি মুছে ফেলার আবেদন করে তা কার্যকর করেছেন, তাদের চিকিৎসার্থে তিনি নিজ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছেন। এই যে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষাবৃত্তি ও ভাতা প্রদান করেছেন, তা কোন দলীয় ভিত্তিতে নয়, দেশবাসী হিসেবেই প্রদান করছেন। বিভাজন রেখা তিনি টানতে চাননি বলেই সকল মত ও পথের মানুষের পাশে তিনি তাদের দুঃখের দিনে দাঁড়াতে পারেন, বাড়াতে পারেন সহায়তা ও আশীর্বাদের হাত। সবার প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি তিনি সব সময়ই দেখান। বৈষম্যমুক্ত সমাজ কাঠামো গড়ে তোলার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানেন তিনি শ্রম ও কর্মেই মুক্তির গান বেজে ওঠে। স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন পিতা। স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু মুক্তি আসেনি। তাই অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য তিনি গত দশ বছর টানা পরিশ্রম করে দেশকে যে জায়গায় উন্নীত করেছেন, তাতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী প্রায়। দারিদ্র্য মোচনের ক্ষেত্রে সাফল্যজনক অবস্থান তৈরি হয়েছে। দেশবাসী জানেন, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে মুক্তির পথ হয়ে গিয়েছিল সঙ্কীর্ণ, সংকুচিত ও কণ্টকাকীর্ণ। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশের তালিকায় অবস্থান নিয়ে হতদরিদ্র মানুষ লাঞ্ছিত-নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিতের তালিকায় আবদ্ধ থেকে জীর্ণ-শীর্ণ জীবনধারায় কাটিয়েছে দীর্ঘকাল। এই বাংলার মানুষ আলোহীন অন্ধকারে যাপিত জীবনে নিরন্ন আর অভাবের চৌহাদ্দিতে গুমরে গুমরে মরেছে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান নামক মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকাই ছিল তার নিয়তি। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষের জীবনে শ্রমের বিনিময়ে যথাযথ মজুরি পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। কঠিন কঠোর কষ্টকর জীবন কেটেছে বাঙালীর। আশা-ভরসার স্থান ছিল না। যেদিকে তাকানো যেত, সেদিকেই ছিল নিরাকার আঁধার। ভূমিহীন মানুষেরা আর্তনাদ আর হাহাকারের মধ্যে নিমজ্জিত থেকে হাবুডুবু খেত। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশ একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও যুদ্ধাপরাধীদের কবলে চলে যাওয়ার পর অবস্থা হয় আরও সকরুণ। পাকিস্তানী মানসিকতার অধিকারীরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জন ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। স্বাধীনতার সুফল যাতে বাংলার মানুষ পেতে না পারে, সেই অবস্থার সৃষ্টি করে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক জান্তা সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। হত্যা, ক্যু, পাল্টা ক্যু, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, লুটপাটের ফলে সঙ্কটের আবর্তে নিমজ্জিত হয় দেশ। কৃষি খাতের স্থবিরতার ফলে খাদ্য খাটতি ও অপুষ্টি অনাহার লেগেই থাকত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সূচিত স্বৈরাশাসন, দুঃশাসন এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান হয়। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, ২০০১ সালে ষড়যন্ত্রমূলক ভোট ডাকাতির নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় ক্ষমতা দখল করে এবং উন্নয়নের বিপরীতে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ধারাই অব্যাহত রাখে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সর্বজনস্বীকৃত অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ আসনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় দেশের ইতিহাসে প্রথম কোন একটি দলের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী জনপ্রিয় নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিনবদলের পালা’ বাস্তবায়নের ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ। ২০১৪-এর নির্বাচন পূর্বাপর অযৌক্তিক ও জনসম্পৃক্ততাহীন ও গণবিরোধী আন্দোলন, আগুন সন্ত্রাস, জনগণের সম্পদ বিনষ্ট, নিরীহ মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সরকার অতি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে এসব চক্রান্ত সামাল দেয় এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নির্বাচনের ভেতর দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় পুনর্বহাল হয়। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় চলতে থাকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে অগ্রযাত্রা। বিশ্বসমাজে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। এই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অবাধ, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। টানা দুই মেয়াদে দশ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার দেশ বিনির্মাণের পথে জাতিকে অগ্রসরমান রেখেছে। শেখ হাাসিনা আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশ পরিচালনায় গণরায় পেয়েছেন। আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশ ও জাাতির উন্নয়ন সাধনে একনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাবেন। আজ সোমবার নয়া মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ। গতকাল রবিবার মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের নাম ও পদ ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি আজ নয়া মন্ত্রিসভার শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। অনেক নতুন মুখ এসেছে। প্রবীণদের ঠাঁই না হলেও তারা দল, সংসদ ও সংসদীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-ভাবনা, চেতনা এবং ঘোষিত ইশতেহার বাস্তবায়নে এই মন্ত্রিসভা কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা সবার। নতুন-পুরনো মিলিয়ে গঠিত মন্ত্রিসভার সামনে ২০২০ সালে মুজিববর্ষ, ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী পালন এবং মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। তাদের মাথার ওপর রয়েছেন শেখ হাসিনা। যিনি সারাবিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন। প্রতিটি গ্রামকে শহর হিসেবে গড়ে তোলার কাজে শেখ হাসিনা পাশে পাবেন নয়া মন্ত্রিসভার সদস্যদের। শেখ হাসিনা নতুন ও তরুণদের মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছেন নয়া প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে। শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন, কবি কিশোর সুকান্তের অমোঘ কবিতা, ‘চলে যাব- তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল? এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এই আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ তারুণ্যের পথকে মসৃণ করে তাদের অগ্রযাত্রায় পথ কেবলই তৈরি করতে পারেন শেখ হাসিনা। আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের স্তরে পৌঁছে যাবে শেখ হাসিনার হাত ধরেই। কালের গতি অবিরাম। সে চলছে এগিয়ে, সাথে মানুষকেও নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু কর্ণধার না থাকলে মানুষ পিছিয়ে পড়তে বাধ্য। শেখ হাসিনার মতো সারথী যে দেশের মানুষের রয়েছে, তাদের এগিয়ে যাবার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে না। শেখ হাসিনা আজ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন তৃতীয়বারের মতো। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বাঙালী আবার গেয়ে উঠবে ‘আমাদের যাত্রা হলো শুরু, ওহে কর্ণধার।’ এই যাত্রার পথ হোক মসৃণ, কন্ঠকমুক্ত।
×