ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসন্ন নির্বাচন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

আসন্ন নির্বাচন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম

৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। নির্বাচন হবে তো? বিএনপি নির্বাচনে যোগ দিবে তো? নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা কী হবে? প্রতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ ও নির্যাতন শুরু হয় তা বন্ধ হবে তো? এসব প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর সঙ্গে সুশীল সমাজের মনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংশয়ের সৃষ্টি করছে, তা হলো নির্বাচনে যদি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার জয়লাভ করতে না পারে তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ভাগ্যে প্রতিবার নির্বাচনের পর যে দুর্ভোগ নেমে আসে তা বন্ধের জন্য কী ব্যবস্থা করা হবে? তাদেরকে কী সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে? নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বন্ধের জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে? নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের ভূমিকা কী হবে? এই প্রশ্ন মনে জাগার অনেক কারণ রয়েছে। ২০০১ নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্যাতনের ঘটনা জাতি এখনও ভুলেনি। এবার নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘুদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে বলে সাধারণ মানুষের মনে সংশয় কাজ করছে। এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যাতে সাম্প্রদায়িক হামলার সুযোগ তৈরি করতে না পারে সেজন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৮ সালের ৩ ও ৪ আগস্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিশেষ প্রতিনিধি সম্মেলনে নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য ৪টি বিশেষ সেল গঠন করা হয়। এগুলো হলো-সাংস্কৃতিক স্কোয়ার্ড, আইন সহায়ক কমিটি, চিকিৎসা সহায়ক কমিটি ও তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল। তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল গঠনের পিছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সকল ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম আজ ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র থেকে আন্তর্জাতিকতায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশেও সাম্প্রদায়িকতা রোধ করতে, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার ও মূলনীতি রক্ষা করতে ইলেট্রনিক গণমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ঠিক তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নানাবিধ তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমও হয়ে উঠেছে ব্যক্তি ও সমষ্টির মতপ্রকাশ ও অধিকার রক্ষার মাধ্যম। বিশেষ করে তারুণ্যের জানা আর জানানোর জগত হয়ে উঠেছে সাইবার বিশ্ব। সঙ্গত কারণেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিও তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগ সেল কার্যকরী করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। এই সেলের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো : ক. তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সৃজনশীল ও রুচিশীলভাবে তারুণ্যের ভাষায় দেশে ও প্রবাসে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস ও চেতনায় আলোকিত করা। খ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক অপশক্তির পাল্টা জবাব ও ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা। গ. দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মুখপাত্র হিসেবে কাজ করা। ঘ. একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভার্চুয়াল আর্কাইভ গঠন ও তহবিল সংগ্রহে এই মাধ্যমকে কাজে লাগানো এবং ঙ. নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপপ্রচার বা অন্য কোন কারণে দেশের কোথাও হামলার ঘটনা ঘটলে এই সেলের মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ করে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ : গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মিথ্যাচার, গুজব রটনা, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধিতা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপপ্রচার করে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত করার অপচেষ্টা বন্ধের লক্ষ্যে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আইনে শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, এই আইনের আওতায় কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন ধরনের প্রপাগা-া চালান, তাহলে তার জন্য ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ধর্মীয় বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে ১০ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো দেশে বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে। তবে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তার সঠিক প্রয়োগ হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এর ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থেকে করা হামলাগুলোকে দাঙ্গা বলা যায় না। দাঙ্গার জন্য দুটি পক্ষ লাগে, আরও বড় এলাকাজুড়ে সহিংসতা ঘটানো হয়। দুটি সম্প্রদায়ের বিরাটসংখ্যক মানুষকে অল্প সময়ের জন্য হলেও দাঙ্গাবাজদের সমর্থন করতে দেখা যায়। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধমন্দিরের পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ঘটনা, ২০১৭ সালের ১০ নবেম্বর রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামের ঘটনা এবং অতিসাম্প্রতিক সময়ে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মুন্সিবাজার কালিপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আশিষ বিজয় দেব তার ফেসবুকে নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এমন প্রচারে তার বাড়িতে হামলার পরিকল্পনা সবই এর দৃশ্যমান প্রকাশ। আসন্ন নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার প্রথাগত পদ্ধতিতে বেশ পরিবর্তন এসেছে। নির্বাচনী প্রচার-প্রসারে এসেছে চোখে লাগার মতো বৈচিত্র্য, যেখানে ইন্টারনেট বেশ বড় একটি ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ করে, ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ আরো কয়েকটি গ্রহণযোগ্য শক্তিশালী সোস্যাল সাইটের কল্যাণে গত কয়েক বছরে এই পরিবর্তনের পরিমাণ বেড়েছে। এক সময়ের সোস্যাল মিডিয়াবিমুখ রাজনৈতিক দলগুলোও ঝাঁপিয়ে পড়ছে ইন্টারনেটের কল্যাণে এগিয়ে যাওয়া এসব মিডিয়ার সুবিধা ভোগ করতে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রায় প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, দলের প্রার্থীর সোস্যাল মিডিয়ায় নিজ নিজ নামে এ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেখান থেকে দল ও দলের প্রার্থীরা নিয়মিত নিজেদের এবং দলীয় মতামত, কর্মকাণ্ডগুলো প্রচার করেন। আর তাদের মতামত ও দলের কর্মকাণ্ডগুলো মুহূর্তের মধ্যে চলে যায় তাদের সমর্থকদের কাছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ আরও কয়েকটি গ্রহণযোগ্য সোস্যাল সাইট ব্যবহার করে থাকে। যার ফলে দলের ও দলের নেতাকর্মীদের মাঝে তাদের মনের ভাব আদান-প্রদান হয়ে যায় অতি সহজে। নেতাকর্মীদের মাঝে কোন দূরত্ব থাকলে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করে তাদের বিরোধ অতি সহজে সমাধান করা যায়। অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলো সোস্যাল মিডিয়ার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান জানতে পারে অতি সহজে। তৃণমূল পর্যায়ের অধিকাংশ নেতাকর্মীর সঙ্গে দলের সোস্যাল মিডিয়ার কানেকশন থাকার কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও তাৎক্ষণিকভাবে স্ব-স্ব এলাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আপডেট দিয়ে জানিয়ে দেয়। এতে করে রাজনৈতিক দলগুলো সে এলাকার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে অতি সহজে। অনেক সময় প্রার্থী তার নির্বাচনী এলাকার সব জায়গায় ও সব নেতাকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে না পারলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অহরহ যোগাযোগ রাখছেন। যার কারণে নেতা ও কর্মীদের মাঝে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তোলছে সোস্যাল মিডিয়া। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করার কারণে আজ বাংলাদেশের মানুষ ইন্টারনেটের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও ভোটের মাঠে নিয়ে এসেছে এক অস্বাভাবিক পরিবর্তন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যাতে ধর্মীয় উস্কানিমূলক পোস্ট বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন ছবি ও ভিডিও প্রচার করে দেশের শান্তি শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করতে না পারে সে দিকে সরকার এবং সুশীল সমাজকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×