ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

অবাধ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮

 অবাধ শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই

শাহীন রহমান ॥ স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দেশে এখন পর্যন্ত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১০ বার। আর কয়দিন পরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। বিগত নির্বাচনগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে নির্বাচনে সহিংসতা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ২০১৪ সালে। এতে প্রায় ১৪১ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ওই বছর প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করে প্রতিহতের ডাকা দেয়ায় এই সহিংতার ঘটনা ঘটে। সহিংসতার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম সংসদ নির্বাচনে। অপর দিকে সবচেয়ে কম সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে ২০০৮ সালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশে যত সহিংসতা হয় তার প্রায় ৭০ ভাই হয় এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনী সহিংসতায় প্রতিপক্ষ লাভবান হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং সংখ্যালঘুরা। তারা বলেন, জাতীয় ও স্থানীয় সবগুলো নির্বাচনে কম বেশি সহিংসতা হলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচনী সংহিসতার কোন বিচার দেশে হয়নি। বিচার না হওয়ার কারণেই সহিংতার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। নির্বাচন এলেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। ভোটারদের মধ্যে নির্বাচনী ভীতি দূর করতে হলে অবাধ সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে একাদশ জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে সব পক্ষের চাওয়া অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যদিও বিরোধী পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে এখন পর্যন্ত নির্বাচনে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। নির্বাচনে প্রতিপক্ষের হমলায় তারা নির্বাচনী প্রচারে যেতে পারছেন না। তারা নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ করতে কমিশনের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বারবারই আভাস দিচ্ছেন এবারের নির্বাচন হবে অবাধ সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ। সারাদেশে নির্বাচনে অনুকূল পরিবেশ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ। সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এটাকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেও উল্লেখ করেন। একই মন্তব্য সাংবাদিকদের কাছে করেছে ইসি সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, নির্বাচনে যে সহিংসতা তা উপমহাদেশের সংস্কৃতি। শুধু বাংলাদেশে নয় বিচ্ছিন্ন এই ঘটনা উপমহাদেশের সব দেশেই পরিলক্ষিত হয়েছে। অপর নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছেন যে বিচ্ছিন্ন সহিংসতা হয়েছে তা বিয়ে বাড়ির ঝগড়ার মতো। নির্বাচনে একটু আধটু উত্তাপ না থাকলে নির্বাচন জমে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্বাধীনতার ৪৭ বছরে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। দেশে কখনো সামরিক শাসনের অধীনে কখনো, তত্ত্ববধায়ক সরকারে অধীনে আবার কখনো রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে নির্বাচনে একটি গ্রহণযোগ্য প্রথা গড়ে না ওঠায় রাজনৈতিক আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ কোন দলের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না। ফলে নির্বাচন এলেই সুষ্ঠু নির্বাচনে দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। তবে এবারে নির্বাচনে প্রেক্ষাপটটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সব দাবি দাওয়া পরিহার করে দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ফলে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। আর যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয় তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদাও বলেন, সরকার, সংসদ বহাল রেখে, সব দলের অংশ গ্রহণে এবারই প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে প্রেক্ষাপট অন্য যে কোন নির্বাচনের প্রেক্ষাপট থেকে ভিন্ন। ফলে নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ করার কোন বিকল্প নেই। বিগত ২০১৪ সালে ৫ জানুুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনী সহিংসতা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আগের বছর ২৫ নবেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ওই সময়ের বিরোধী দল ছয় দফায় ২৬ দিন অবরোধ কর্মসূচী পালন করেছে। এ সময় সারাদেশে প্রাণ হারায় ১২৩ জনের। নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় প্রাণ হারায় আরও ১৮ জনের। সব মিলিয়ে নির্বাচনপূর্ব সময় থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত ওই বছর মোট ১৪১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে এত প্রাণহানির ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। বিভিন্ন নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, ব্যালট পেপার ও নির্বাচনী সামগ্রী লুটপাট শুরু হয়। পুড়িয়ে দেয়া হয় প্রায় দেড়শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের পাঁচ শতাধিক ভোটকেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ ও স্থগিত করা হয়। ২ জন প্রিসাইডিং অফিসারও নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকালে মৃত্যুবরণ করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৯১ সালে একটি গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু হয় দেশে। তার পর থেকে এ পর্যন্ত ছয়বার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার আগে সামরিক শাসনের অধীনে ৩ বার একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে দেশে প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দলীয় সরকারের অধীনে। তবে সেই নির্বাচনেও সহিংসতার কোন ঘটনা ঘটেনি। ১৯৯১ সালেও একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯৬ সালে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বাদ দিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে বিএনপি। ওই নির্বাচনেও ব্যাপক সহিংসতা দেখা দেয়। সহিংসতার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখ গেছে এতে ৪১ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০০১ সালেও নির্বাচন পরবর্তী ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। ওই নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কোন ধরনের সহিংসতার খবর পাওয় যায়নি। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ওই বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য গত ৮ নবেম্বর তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। পরে পুনতফসিলে নির্বাচনের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকলেও দলীয় মনোনয়ন বিতরণকালে পরিবেশ হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। বিএনপির অফিসের সামনে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগ পাওয়া যায়। অপর দিকে আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর কোন্দলের কারণে মোহাম্মদপুরে ২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এছাড়া দলীয় মনোনয়ন কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধও চাঙ্গা হয়ে ওঠে। নরসিংদীসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বেশ কয়েজনের মৃত্যু ঘটে। ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় নির্বাচন প্রচার। প্রচারের শুরুতেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিপক্ষের হামলা, পাল্টা হামলার মধ্যে বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এতে নোয়াখালী এবং ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের দুই সমর্থকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেন সারাদেশে তিনশ’ আসনের নির্বাচনের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক। নির্বাচনে সহিংসতা পরিহার করার জন্য তিনি রাজনৈতিক দল ও দলীয় সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান। এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কর্মসমর্থকদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও এখন পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল, বিএনপি মহসচিব মির্জা ফখরুলসহ বিভিন্ন দলের কেন্দ্রী নেতাকর্মীর গাড়ি বহর ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল থেকে একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করছেন। আওয়ামী অভিযোগ করেছে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই এই হামলা রয়েছে। অপর দিকে বিএনপি বলছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনই হামলার সঙ্গে জড়িত। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এখন পর্যন্ত বেশি সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটেছে সিলেট-১ আসনে। বলা হয়েছে থাকে এই আসনে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করেন সেই দলই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অধিষ্ঠিত হয়। তবে নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, সহিংসতার এই মাত্রার অনেকটাই কমে আসছে। ২৪ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে সেনাবাহিনী সদস্যদের মোতায়েন করা হচ্ছে। কমিশন আশা করছে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামলেও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। প্রার্থী, সমর্থক এবং ভোটারদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে। নির্বাচন হবে গ্রহণযোগ্য। ঢাকা ১৪ আসনের কয়েকজন ভোটার এ প্রতিবেদনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, নির্বাচনে ভোট দেয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে পরিবেশের ওপর। পরিবেশ যদি ভোট দেয়ার উপযোগী হয় তাহলে কেন্দ্রে যাব। না হলে ঘরে থাকব সেদিন। তারা বলেন, যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন শান্তিপূর্ণ ভোটই সবাই আশা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকলে ভোটার উপস্থিতি বেড়ে যায়। সহিংসতা হলে স্বাভাবিকভাকেই উপস্থিতি কমে যায়। সহিংসতা হলে নারী ভোটাররা কেন্দ্রেই যেতে চান না।
×