ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রিমলাইনার দিয়ে লন্ডনে সপ্তাহে ৬ ফ্লাইট চালানোর ঘোষণার পর বাতিল

বিমানের চার ব্র্যান্ড নিউ ৭৭৭ প্লেনের অধিকাংশ মনিটর নষ্ট

প্রকাশিত: ০৬:১২, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮

বিমানের চার ব্র্যান্ড নিউ ৭৭৭ প্লেনের অধিকাংশ মনিটর নষ্ট

আজাদ সুলায়মান ॥ চারটি ব্র্যান্ড নিউ ৭৭৭ উড়োজাহাজের অধিকাংশ মনিটর নষ্ট। টাকার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। ড্রিমলাইনার দিয়ে লন্ডনে সপ্তাহে ৬টি ফ্লাইট অপারেট করার ঘোষণা দিয়ে মাত্র তিনদিনের মাথায় তা বাতিল করা হয়। প্রায়ই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলম্ব হচ্ছে ফ্লাইট। প্রকৌশল ও পরিকল্পান বিভাগে উচ্চ বেতনে দুজন পরিচালক নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের পারফর্মেন্স নিয়ে হতাশ বিমান। দীর্ঘদিন পর ৩৩ জন শিক্ষানবিস অফিসার নিয়োগ দিলেও তাদের পদায়ন দিতে পারছে না বিমান, বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে। আবার ঘোষণা দিয়ে ক্যাজুয়াল শ্রমিকের মাত্র গুটিকয়েকজনের চাকরি স্থায়ী করার সিদ্ধান্তে ফের অসন্তোষ দানা বাঁধছে। তারা এখন আন্দোলন ও আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংকটের শেষ এখানেই নয়। ভিয়েতনামে এক বছর ধরে পড়ে রয়েছে লিজে আনা দুটো ৭৭৭-২০০ ইআর। এ দুটোর জন্য নির্ধারিত ৫টি ইঞ্জিন ঠিক করতে দরকার কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডলার। এমন ত্রিশঙ্কু পরিস্থিতির মাঝে আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হবে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম)। এসব ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে পারে সাধারণ সভা। এরই মাঝে দাবি উঠেছে-বিমানকে সঠিক পথে গতিশীল করতে দরকার একটি পেশাদারিত্বের সমন্বিত পর্ষদ। জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ বলছেন, ভিয়েতনামে পড়ে থাকা দুটো বোয়িং কবেনাগাদ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে তা বলা মুস্কিল। তবে শীঘ্রই আনার চেষ্টা চলছে। বিমানের অর্থ শাখা জানিয়েছে, একদিকে আর্থিক সংকট, অন্যদিকে প্রকৌশল শাখার অথর্ব-অযোগ্য লোকজনের স্বেচ্ছাচারিত, দুর্নীতি ও অরাজকতার দরুন একের পর এক উড়োজাহাজ যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ছে। গ্রাউন্ডেড হয়ে আছে লিজে আনা উড়োজাহাজ। অধিকাংশ মনিটর নষ্ট ॥ মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই ৭৭৭ উড়োজাহাজের অধিকাংশ ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট মনিটর নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো ঠিক করার উদ্যোগ নিতে পারছে না। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে প্রায়ই উড়োজাহাজে বাদানুবাদ হয়। আকাশে থাকাবস্থায় সঠিকভাবে সতর্ক ও নজরদারি না রাখায় একের পর এক মনিটর নষ্ট করে যাত্রীরা। এ প্রসঙ্গে বিমানের সাবেক একজন পরিচালক জানান, ফ্লাইটের যাত্রীরা অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্য রুটের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত। তারা সঠিকভাবে এসব মনিটর ব্যবহার করতে জানেন না। তাদের ফ্লাইটেও এগুলো কিভাবে অপারেট করতে হয়, কতটা সতর্কতার সঙ্গে ধরতে হয়Ñ সে পরামর্শও ঠিকমতো দেয়া হয় না। এদিকে বিমানের গ্রাহকসেবার অভিযোগÑ প্রকৌশল বিভাগের বর্তমান পরিচালক যোগ দেয়ার পর থেকেই একের এক উড়োজাহাজ যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হচ্ছে। এতে সিডিউল বিঘিœত হচ্ছে প্রায়ই। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে-যাত্রীদের উড়োজাহাজে বসিয়ে রেখে প্রায়ই উড়োজাহাজের চাকা লাগানোসহ অন্যান্য ত্রুটি ঠিক করা হচ্ছে। এতে নির্ধারিত সময়সূচী মেনে ফ্লাইট উড়তে পারছে না। এমনকি ভিভিআইপি ফ্লাইটেও ঘটেছে যাত্রী অনবোর্ড রেখে চাকা লাগানোর ঘটনা। কেন এমনটি ঘটছে জানতে চাইলে বিমানের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, সম্প্রতি উচ্চ বেতনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া প্রকৌশল পরিচালকের এ ধরনের দায়িত্ব পালনে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা ছিল না। উড়োজাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটির মতো দায়-দায়িত্ব পালনে তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে অন্যান্য অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর ওপর। গ্রাহক সেবা কর্মকর্তাদের অভিযোগ, যাত্রী বোর্ডিং হবার পর চাকা লাগানোর ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। যা বিমানের চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এমন নজির নেই। শুধু এ কারণেই এখন ফ্লাইট ডিলে হচ্ছে। জানতে চাইলে প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক সাজ্জাতুর রহিম বলেন, এটা ঠিক নয়। যান্ত্রিক ত্রুটি কখন দেখা দেবে সেটা তো কেউ বলতে পারে না। যখনই দেখা দেয় তখনই কাজ করা হয়। লন্ডনে বন্ধ ড্রিমলাইনার ॥ আগে ৭৭৭ দিয়ে লন্ডনে সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট অপারেট করা হতো। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে লন্ডনে সপ্তাহে ৬টি ফ্লাইট অপারেট করার। সেভাবে প্রথম তিনটা ফ্লাইট অপারেট করা হয় ড্রিমলাইনার হংসবলাকা দিয়ে। তারপর হঠাৎ সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়। অথচ এ জন্য ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা পয়সা খরচ করে এ প্রস্তুতি নেয়া হয়। এখন ড্রিমলাইনারের পরিবর্তে ৭৭৭ দিয়েই সপ্তাহে ৬টি ফ্লাইট অপারেট করতে হচ্ছে। এতে বিমানের আর্থিক গচ্ছার পাশাপাশি ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে মারাত্মক। কেননা ইতোমধ্যে ড্রিমলাইনারের নামে টিকেট বিক্রি করা হয়ে গেছে বিপুল সংখ্যক। অনেকেই শুধু ড্রিমলাইনারে চড়ার জন্য টিকেট কিনেছেন। এখন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চড়তে হচ্ছে ৭৭৭ উড়োজাহাজে। এতে ২৭১ যাত্রীর ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৬টি ড্রিমলাইনারে ১৬২৬ জন যাত্রীকে পাঠাতে হচ্ছে ৪১৯ আসনের ৭৭৭ দিয়েÑ যার সাপ্তাহিক ক্যাপাসিটি ২৫১৪ জন। এতে বিমানের ক্যাপাসিটি লস হচ্ছে ভীষণ। এমন তুঘলকি কা-ের জন্য কারা দায়ী জানতে চাইলে প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, লন্ডনে যাওয়ার মতো ড্রিমলাইনারের ককপিট ক্রু তৈরি করতে পারেনি বিমান। সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এ জটিলতা দেখা দিয়েছে। ডিএফও এ নিয়ে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। তিনি বাপার পরামর্শে কাজ করতে গিয়ে এ জটিলতা ডেকে আনেন। ড্রিমলাইনারের জন্য ককপিট ক্রু তৈরি নিয়ে তার স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই এ সংকট। ফের ক্যাজুয়ালদের হুমকি ॥ দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামের মুখে বিমান কর্তৃপক্ষ মাস দুয়েক আগে ঘোষণা দেয় তাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে। পরে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বিমান ঘোষণা দেয় আপাতত যারা ১২ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন, শুধু তাদেরই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হবে। বিমান সিবিএ নেতা সভাপতি মশিকুর রহমান বলেন, এ সিদ্ধান্তের দরুন ক্যাজুয়াল আড়াই হাজার শ্রমিকের মধ্যে মাত্র শ’তিনেকের চাকরি স্থায়ী হবে। এতে কিছুৃটা জটিলতা দেখা দিলেও এই মুহূর্তে কৌশলগত কারণে জাতীয় নির্বাচনের সময় বড় আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। বসিয়ে বেতন দেয়া হচ্ছে ॥ দীর্ঘদিন পর ৩৩ জন শিক্ষানবীস অফিসার নিয়োগের উদ্যোগ নেয় বিমান। বিমানের নিয়োগবিধি মেনেই তাদের চূড়ান্ত নিয়োগ দানের পর প্রশিক্ষণও শেষ করা হয়। তাদের যখনই বিভিন্ন শাখায় শূন্যপদের বিপরীতে পদায়ন করা হয় তখনই বাধা আসে সাধারণ কর্মচারীদের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে প্রচ- গোলযোগ দেখা দেয়। পদায়নপত্র হাতে নিয়ে বলাকায় কাজে যোগ দিতে গিয়ে এ সব শিক্ষানবীস অফিসাররা শুধু বাধারই সম্মুখীন হননি, তাদের ক’জনকে দস্তুরমতো লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে বিমান বাধ্য হয় তাদের যোগদান থেকে বিরত রাখতে। তাদের এখন বিএটিসি-তে সংযুক্ত করে বসিয়ে রেখে বেতন দেয়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী এক অফিসার বলেন, বিমান পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্ট কতটা অথর্ব ও দুর্বল এটাই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ভিয়েতনামে পড়ে আছে দুটো ৭৭৭ ॥ মিসর থেকে লিজে আনা দুুটো ৭৭৭-২০০ ইআর উড়োজাহাজের ইঞ্জিন মেরামত করার জন্য পাঠানো হয় ভিয়েতনামে এক বছর আগে। এখনও পড়ে আছে সেখানে। বিমান আনতে পারছে না টাকার অভাবে। এ দুটোর জন্য পাঁচটি ইঞ্জিন মেরামত করতে কমপক্ষে ১০০ মিলিয়ন ডলার দরকার। বিমানের কাছে নেই এ টাকা। বাধ্য হয়েই ভিয়েত নামে ফেলে রাখা হচ্ছে।
×