ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

নিষ্পাপ শিশু সিয়ামকে শীতলক্ষ্যায় ফেলে হত্যা করা হয়

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

নিষ্পাপ শিশু সিয়ামকে শীতলক্ষ্যায় ফেলে হত্যা করা হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছয় বছরের নিষ্পাপ শিশু সিয়াম। পৃথিবীর নির্মমতার কিছুই বোঝার কথা নয়। মানুষের ভাল-মন্দ তাও জানার মতো বয়স নয়। পরিচিত নিকটজন কিভাবে কখন শত্রু হয়ে ওঠে- সেটাও তার পক্ষে উপলব্ধি করার নয়। শুধু এজন্যই সিয়ামকে নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। পানিতে ছুড়ে ফেলে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ঘাতক অচেনা অজানা কেউ নয়। তারই বাবার ইটখোলার শ্রমিক মিঠু মিয়াÑযার হাত ধরে ঘর থেকে বের হয়েছিল সিয়াম। যে মানুষটি বাবার সঙ্গে কাজ করত, বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া করত, মাঝে মাঝেই যার সঙ্গে গল্প করত, যার হাত ধরে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিল-তারই নির্মম পাষন্ড তার শিকার হতে হয়েছে সিয়ামকে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ছুড়ে ফেলে মারা হয় সিয়ামকে। আজও সিয়ামের মরদেহের কোন সন্ধান মেলেনি। এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে গত ১৩ সেপ্টেম্বর। বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব-১ বিশেষ অভিযান চালিয়ে ঘাতক মিঠুকে গ্রেফতারের পর সে সিয়ামকে পানিতে ফেলে হত্যার কথা স্বীকার করে। রাতভর জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে জানায়, ব্রিজ থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাতে থাকা ছেড়া কাগজ ফেলে দেয়ার মতো ছুড়ে ফেলা হয় সিয়ামকে। এতে তার বিন্দুুমাত্র খারাপ লাগেনি। হাতটা পর্যন্ত কাঁপেনি। এ লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়ার পর এতটুকু অনুশোচনাও দেখা যায়নি তার মাঝে। বরং উল্টো আরও ওজর দেখিয়েছে-সিয়ামের বাবা তাকে একদিন বকাঝকা করেছে। তারই বদলা নিতে সিয়ামকে পানিতে ছুড়ে মারে সে। সিয়ামের বাবা মোফাজ্জল হোসেনের বাসা রূপগঞ্জের বিরাব খালপাড়ে। সিয়াম বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। মাস চারেক আগে শিশু সিয়ামের বাবা মোফাজ্জল হোসেনের ইটের ট্রলিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে আসামি মিঠু মিয়া (২৬)। মিঠু তাদের বাসাতেই থাকত। সেখানেই তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কাজ শুরুর ১৫/১৬ দিন পর মিঠুর সঙ্গে হৃদয় নামে অপর এক শ্রমিকের ঝগড়া হয়। এটি সমাধানে মালিক মোফাজ্জল মিঠুকে চড়-থাপ্পড় ও বকাবকি করেন। ওই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হন মিঠু মিয়া। এরপরই প্রতিশোধস্পৃহায় মিঠু সুযোগ খুঁজতে থাকে। এ অবস্থায় ১৩ সেপ্টেম্বর মালিকের শিশু সন্তান সিয়ামকে (৬) বেড়ানোর কথা বলে বের হয় মিঠু। সেই শেষ যাওয়া। আর ফিরেনি সিয়াম। মিঠুও নিখোঁজ। সেও আর ফিরেনি। ক’দিন পর মিঠু ফোন করে সিয়ামের মা ফারজানার কাছে। সে অবলীলায় বলে ফেলে, তোর সিয়ামকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলেছি। তারপর থেকে উন্মাদের মতো চিৎকার করে এ ঘটনা বলতে থাকেন ফারজানা। তিনি বিষয়টি আবারও থানা পুলিশ ও র‌্যাবকে অবহিত করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর ফারজানা বাদী হয়ে পলাতক শ্রমিক মিঠু এবং তার বাবা আনোয়ারসহ অজ্ঞাত ২/৩ জনকে আসামি করে রূপগঞ্জ থানায় একটি অপহরণের মামলা দায়ের করেন। এরপর মিঠুকে ধরতে র‌্যাব-১ মাঠে নামে। বৃহস্পতিবার রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানাধীন গন্ধবপুর এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে সিয়ামের অপহরণকারী ও খুনীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। রাতেই জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে নির্মম ওই খুনের ঘটনার চাঞ্চল্যকর তথ্য। ঘাতক ধরা পড়লেও শিশু সিয়ামের মরদেহ এখনও উদ্ধার করতে পারেননি পুলিশ, র‌্যাব কিংবা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ বিষয়ে শুক্রবার দুপুরে উত্তরায় র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার পুলিশ সুপার মোঃ আনোয়ার হোসেন পুরো ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে মোফাজ্জলের ছেলে সিয়ামকে রূপগঞ্জের কাঞ্চন ব্রিজে ঘুরতে নিয়ে যায় মিঠু। সেখানে সন্ধ্যা নেমে এলে একপর্যায়ে ব্রিজের রেলিং থেকে ধাক্কা দিয়ে শিশু সিয়ামকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয় সে। এরপর সেখান থেকে ঘাতক মিঠু পালিয়ে তার নিজ বাড়ি গন্ধবপুরে চলে যায়। শিশু সিয়ামের নিখোঁজের বিষয়টি ওই সময় ব্যাপক আলোচিত হয়। সে সময় আসামি মিঠু ও তার পরিবারের সব সদস্য নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। পুলিশ সুপার মোঃ আনোয়ার হোসেন আরও জানান, গ্রেফতারের পর আসামি মিঠু সিয়াম হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন। মিঠু স্বীকার করেছেন- মোফাজ্জল হোসেন তাকে চড়-থাপ্পড় ও গালাগালি করেন। এর প্রতিশোধ নিতে শিশু সিয়ামকে ব্রিজ থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করেন। যদিও এখন পর্যন্তশিশু সিয়ামের মরদেহ পাওয়া যায়নি। আমরা আসামি মিঠুকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলে সে বিষয়টি স্বীকার করে’- বলেন র‌্যাব কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী সিয়ামের মা ফারজানা বলেন, বাসা থেকে মিঠু আমার সন্তানকে নিয়ে যায়, তারপর সন্ধ্যা হয়, রাত হয় কিন্তু সিয়াম আসে না। আমি ও আমার স্বামী বিভিন্ন স্থানে সিয়ামের খোঁজাখুঁজি করি কিন্তু কোথাও পাইনি। পরে একদিন মিঠু ফোন করে বলে, তোর ছেলেকে ফেলে দিয়েছি। এরপর থানায় গিয়ে অপহরণের মামলা করি। তিনি বলেন, যাকে আমরা খাওয়াইছি, থাকার জায়গা দিছি; সে-ই আমার আদরের নিষ্পাপ শিশু সন্তানকে এমনভাবে হত্যা করেছে, আমি এর বিচার চাই। এদিকে সিয়ামের মরদেহ কবে নাগাদ উদ্ধার করা সম্ভব হবে এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি রূপগঞ্জ পুলিশ ও র‌্যাব।
×