ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২ ডিসেম্বর ২০১৮

চলে গেলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। শুধু মাথাই ঠেকালেন না, রীতিমতো সারাজীবনের জন্য নিজের দেশের মাটিতে মাথাসহ পুরো শরীর রাখলেন। চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন দেশের মাটিতে। দেশের প্রতি ভালবাসার টানে ফ্রান্সের নাগরিক হয়েও আবার দেশে বসবাস শুরু, শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও হলো দেশেই। বাংলাদেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রী, পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক আনোয়ার হোসেনের ক্ষেত্রেই শিল্পীর সেই কথাই সত্যি হলো। লাশ রাখা হবে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে। আজ বেলা এগারোটায় তাকে শ্রদ্ধা জানানোর কথা রয়েছে। জানাযা শেষে তার লাশ মিরপুর শহীদ বুদ্বিজীবী করবস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত বিশেষ কোন কারণ ছাড়া পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গুণী এই শিল্পীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফ্রান্সের এই নাগরিকের লাশ উদ্ধার হয়েছে ঢাকার ধানম-ির পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হেভেনের একটি কক্ষ থেকে। দরজা ভেঙ্গে তার লাশটি উদ্ধার করে পুলিশ। সত্তর বছর বয়সী এই গুণী শিল্পীর মৃত্যুতে শোবিজ জগতে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। তার মৃত্যুতে সৃষ্টি হয়েছে নানা রহস্যের। যদিও পুলিশ বলছে তার মৃত্যুতে রহস্যজনক কোন কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তার পরেও বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য লাশের পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। শনিবার রাতেই লাশ নিহতের দুই ভাইয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সূর্যদীঘল বাড়ি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, লালসালু ও অন্যজীবন সিনেমাসহ অসংখ্য সিনেমার চিত্রগ্রাহক ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনিই বাংলাদেশের আলোকচিত্রীদের পুরো একটি প্রজন্মকে নতুন পথের দিশা দিয়েছেন। শনিবার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে পান্থপথের ১৫/৩ নম্বর হোটেল ওলিও ড্রিম হেভেনের কক্ষ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে তা পাঠানো হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে। শেরেবাংলা নগর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) লিটন মাতাব্বর জনকণ্ঠকে বলেন, একটি কাজের জন্য তিনি ঢাকায় আসেন। ওঠেন হোটেলটির নবম তলার ৮০৯ নম্বর কক্ষে। সকালেই আনোয়ার হোসেনের কাজে যাওয়ার কথা। সে মোতাবেক আনোয়ার হোসেনের ঘনিষ্ঠজনরা সকালেই তাকে ফোন করেন। বার বার ফোন করেও না পেয়ে তারা হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পুলিশ গিয়ে দরজা ভেঙ্গে লাশটি উদ্ধার করে। উদ্ধারকালে লাশটি স্বাভাবিক অবস্থায় বিছানায় শোয়া ছিল। তার মৃত্যুর পেছনে দৃশ্যমান সন্দেহজনক কোন কিছুর অস্তিত্ব মেলেনি। তারপরেও মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে লাশের সুরতহাল করা হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। বিষয়টি সম্পর্কে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, রাতেই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে তার মৃত্যুর পেছনে সন্দেহজনক কোন কিছুর আলামত মেলেনি। ঘুমের মধ্যে হার্টএ্যাটাক বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তারপরেও বিষয়টি নিশ্চিত হতে পোস্টমর্টেম করা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। নিহত আনোয়ার হোসেনের ছোট ভাই আলী হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের পিতার নাম মৃত মোহাম্মদ হোসেন। মা মৃত আসাদুন্নেছা। তারা চার ভাই, চার বোন। এর আগে এক বোনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ সবার বড় আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু হলো। আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৪৮ সালের ৬ অক্টোবর পুরনো ঢাকার আগানবাগে দেউড়িতে। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ফ্রান্সে বসবাস করে আসছেন। তিনি সে দেশের নাগরিকও। বিয়ে করেছেন একজন ফ্রান্সের মেয়েকে। আনোয়ার হোসেনের সংসারে স্ত্রী ছাড়াও দুই ছেলে আকাশ ও মেঘদূত আছে। তারা ফ্রান্সেই বসবাস করে। বড়ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পাঠানো হয়েছে। ভাবি ও ভাতিজারা দেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিহত আনোয়ার হোসেন প্রথম জীবনে প্রখ্যাত অভিনেত্রী ডলিকে বিয়ে করেন। এরপর তার নাম হয় ডলি আনোয়ার। ডলি ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র সুর্যদীঘল বাড়িতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আনোয়ার হোসেনের ছোট ভাই আরও জানান, ফ্রান্সের নাগরিক হলেও দেশটি তার ভাইকে হয়ত তেমন টানত না। কারণ তিনি যদি দুই মাস ফ্রান্সে থাকতেন, তবে তিন মাস থাকতেন বাংলাদেশে। দেশের মাটির টানে দুই বছর আগে বড়ভাই দেশে ফিরে দেশেই বসবাস শুরু করেন। কিন্তু তার কোলাহল পছন্দ নয়। তাই তিনি যখন দেশে আসতেন উঠতেন গিয়ে হোটেলে। ঢাকায় তাদের বাসায় যেতেন। তবে থাকতেন না। কারণ বাসায় ছেলে-মেয়ে কোলাহল করে। তাই তিনি বেছে নিলেন ছায়া ঘেরা শরীয়তপুর জেলাকে। সেখানেই শুরু করেন বসবাস। সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন না। যখন দেশে ফিরতেন তখন, ঢাকার কাজ শেষে শরীয়তপুরে চলে যেতেন। গত ২৮ নবেম্বর তিনি কাজের জন্য ঢাকায় আসেন। পুরনো ঢাকায় বাড়িতে যান। সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হয়। কোলাহল তার সহ্য না হওয়ায় তিনি গিয়ে ওঠেন হোটেলটিতে। তিনি ফিনিক্স ফটোগ্রাফি সোসাইটি নামের একটি আলোকচিত্রী প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবে কাজ করছিলেন। ছোটবেলায় আঁকাআঁকির মাধ্যমেই রঙের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটে এই বরেণ্য আলোকচিত্রীর। ভর্তি হয়েছিলেন বুয়েটের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে। কিন্তু স্থপতি হওয়ার পাঠ না চুকিয়েই সিনেমাটোগ্রাফি পড়তে চলে যান ভারতের পুনেতে। ক্যামেরা হাতে কাজ করেছেন সূর্যদীঘল বাড়ি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রে। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। চিত্রগ্রাহক পরিচয়ের চেয়েও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন আলোকচিত্রী হিসেবে। দেশের বাইরেও তার সে খ্যাতি আছে। তার হাত ধরেই এদেশে তৈরি হয়েছে অসংখ্য আলোকচিত্রী। আনোয়ার হোসেনের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবিগুলো হলো- সূর্যদীঘল বাড়ি (১৯৭৯), এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী (১৯৮০), পুরস্কার (১৯৮৩), অন্য জীবন (১৯৯৫) ও লালসালু (২০০১)।
×