ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অবহেলায় অযত্নে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঐতিহ্যবাহী রাজা টঙ্কনাথের বাড়ি

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২৪ নভেম্বর ২০১৮

 অবহেলায় অযত্নে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে  ঐতিহ্যবাহী রাজা টঙ্কনাথের বাড়ি

নিজস্ব সংবাদদাতা, ঠাকুরগাঁও ॥ শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী রানীশংকৈল উপজেলার পূর্ব প্রান্তে কুলিক নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত ১০৩ বছরের মালদুয়ার জমিদার রাজা টঙ্কনাথের রাজবাড়ি। অবহেলায় অযত্নে আর সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে ঐতিহ্যবাহী এই জমিদার বাড়িটি। দীর্ঘদিন যাবত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে এই রাজবাড়িটি। দেয়ালের প্রতিটি অংশ এখন ধ্বংসের পথে। দেয়ালের কম বেশি সব খানেই জংলি গাছ বেড়ে ওঠায় রাজবাড়িটি জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে। এরপরও রাজবাড়িটি একনজর দেখার জন্য কমেনি দর্শনার্থীদের সমাগম। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এখনও আসছে বাড়িটি দেখতে। ঐতিহ্যবাহী রাজা টঙ্কনাথের রাজবাড়িটি সংস্কার করে সেটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দীর্ঘদিনের দাবি এলাকাবাসীর। জানা যায়, রাজা টঙ্কনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ ছিলেন মৈথিলি ব্রাহ্মণ। রাণীশংকৈল থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে কাতিহার শ্যামরাই মন্দিরের সেবাইত ছিলেন বুদ্ধিনাথ। উক্ত মন্দিরটির মালিক ছিলেন ঘোষ বা গোয়ালা বংশীয় নিঃসন্তান এক জমিদার। বৃদ্ধ গোয়ালা জমিদার কাশিবাসে যাওয়ার সময় সমস্ত জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান এবং তাম্র পাতে দলিল করে যান যে, তিনি কাশি থেকে ফিরে না এলে সেবাইত বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হবেন। পরে জমিদার ফিরে না আসলে বুদ্ধিনাথ জমিদারির মালিক হয়ে যান। তবে অনেকে মনে করেন এ ঘটনাটি বুদ্ধিনাথের দু-এক পুরুষ পূর্বেরও হতে পারে। মতান্তরে আঠারশ’ খ্রীস্টাব্দের শেষের দিকে মালদুয়ারের নাম ছিল রামগঞ্জ। সে সময় এলাকার জমিদারি ছিল দুই সহোদরের হাতে। নাথপন্থী এই সহোদর যুগল ছিলেন চিরকুমারী। তারা পরিচিত ছিলেন বড় রানী ও ছোট রানী হিসেবে। উভয় রানী কাশীধামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাম্রপাতে জমিদারি বুদ্ধিনাথের নামে লিখে দেন। কথা ছিল তারা ফিরে না আসলে জমিদারি সেবায়েতের হয়ে যাবে। রানীরা আর ফিরে আসলেন না। রাজবাড়ি নির্মাণের কাজ বুদ্ধিনাথ শুরু করলেও সমাপ্ত করেন রাজা টঙ্কনাথ রায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রাজবাড়িটি নির্মিত হয়। বুদ্ধিনাথের তিন ছেলে রামনাথ, টঙ্কনাথ ও গৌরাঙ্গনাথ। রামনাথের অকাল মৃত্যু হয়। গৌরাঙ্গ ছিল হাবা গোবা। টঙ্কনাথ ছিল চতুর। বুদ্ধিনাথের মৃত্যু হলে টঙ্কনাথ সমস্ত জমিদারি হাতিয়ে নেয়। ঊনবিংশ খ্রীস্টাব্দের প্রথম দিকে এই জনপদটি ছিল মালদুয়ার পরগনার অন্তর্গত। পরে টঙ্কনাথ ব্রিটিশ সরকারের আস্থা লাভ করে মালদুয়ার এস্টেট গঠন করেন। কথিত আছে, টাকার নোট পুরিয়ে জনৈক ব্রিটিশ রাজ কর্মচারীকে চা বানিয়ে খাইয়ে টঙ্কনাথ চৌধুরী উপাধি লাভ করেন। এর পর দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজা নাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে রাজা উপাধি পান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শাসন থেকে মুক্ত হলে রাজা টঙ্কনাথ চৌধুরী ১৭ আগস্ট সপরিবারে ভারতে চলে যান। তখন থেকে বিশাল রাজবাড়ি জীর্ণশীর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ইতোমধ্যে রাজবাড়িটির অনেক অংশই নষ্ট ও ধ্বংস হয়ে গেছে। চারপাশে ছিন্নমূল মানুষের বসবাস। দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না হওয়ায় রাজবাড়িটি যে কোন মুহূতে ভেঙ্গে পড়তে পারে । চুরি হয়ে যাচ্ছে ইটসহ দামী শৌখিন দরজা, জানালা ও লোহার জিনিসগুলো। স্থানীয়রা জানান, এই রাজবাড়িটি আমাদের এলাকার একটি ঐতিহ্য। এটি দীর্ঘদিন ধরেই পড়ে আছে। প্রতিদিন এটি দেখতে অনেকেই আসেন। যদি এটিকে সংস্কার করা হয় তাহলে আবারও আমাদের ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটি সকলের কাছে দর্শনীয় হয়ে উঠবে। সম্প্রতি রাজবাড়ি দেখতে আসা মনি রুপা আশরাফসহ তাদের দলের অনেকেই বলেন, বন্ধুরা মিলে এসেছি এই রাজবাড়িটি দেখতে। অনেকের মুখেই শুনেছিলাম এটির কথা। বাড়িটি অনেক সুন্দর কিন্তু দেখতে ভয় লাগছে। কারণ এটি পুরোটাই একটি জঙ্গলের মতো হয়ে যাচ্ছে। রাজবাড়িটি সংস্কার করা হলে অনেক ভাল হবে। রাজা টঙ্কনাথের স্মৃতি বিজড়িত কীর্তিকে অমর করে রাখার জন্য এই রাজবাড়িটির সংস্কার ও সংরক্ষণ আজ বড় প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ধরে রাখার প্রবল প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন রাণীশংকৈলবাসী। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড. কে.এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, রাজবাড়িটি অনেক আগের। ইতোমধ্যে আমি এটি পরিদর্শন করেছি। আমরা চেষ্টা করব এটি সংস্কার করে ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার।
×