ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তৌফিক অপু

প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে ওঠা

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

প্রযুক্তির সঙ্গে বেড়ে ওঠা

স্কুল ভ্যান থেকে নেমে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে কি যেন মনোযোগ দিয়ে দেখছে নিহাল। কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে নিচে নিহালকে নিতে এসে নিহালের মা লক্ষ্য করল ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার কোনায় কয়েকটি ছেলের মার্বেল খেলা দেখছে। নিহালের মনে হচ্ছে যেন এক অদ্ভুত খেলায় মেতে উঠেছে ওরা। আঙ্গুলের জোরে ছোট্ট একটি মার্বেল আর একটি মার্বেলকে গুঁতো দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে। এ যেন বিস্ময়কর এক ব্যাপার। কিছুতেই চোখ সরাতে পারছে না মার্বেল খেলা থেকে। ওদিকে মা ডেকেই চলছে তাতে ভ্রƒক্ষেপ নেই নিহালের। হঠাৎ বলে উঠল মা আমি খেলি ওদের সঙ্গে, তাৎক্ষণিক মা উত্তর দিল ওসব খেলে তোমার কাজ নেই, আগে ঘরে চলো। বাইরে অনেক রোদ, নাস্তা খেয়ে একটু মোবাইলে গেইম খেলে নিও। নিহালের অনেক মন খারাপ হলেও মায়ের প্রস্তাবটাও তার মন্দ লাগেনি। কারণ মোবাইলে গেম খেলতে তার বেশ লাগে। এছাড়া মা একটু চোখের আড়াল হলে হুট করে ইউটিউব থেকেও ঘুরে আসা যায়। কারণ পুরো বাড়িটাই যে ওয়াইফাই জোন। এ চিত্র যে শুধু এখন নিহালে বাসায় তা নয়, এ দেশের বিশেষ করে ঢাকার প্রায় প্রতিটি ঘরের দৃশ্য। আর এ দৃশ্যপটের ফলাফল হচ্ছে মোবাইল ফোন তথা প্রযুক্তির প্রতি বাচ্চাদের আসক্তি। একটা সময় শীতের শুরুতে গ্রামের প্রতিটি খেলার মাঠে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শহরেও দেখা গেছে উৎসবের আমেজ। অর্থাৎ বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। আর এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিজ নিজ স্থানের খেলোয়াড়দের মধ্যেও আগ্রহের কমতি থাকত না। সে দৃশ্য যেন এখন অনেকটাই অতীত। ফাঁকা পড়ে থাকছে গ্রামের মাঠগুলো এবং শহরের মাঠগুলো বিভিন্ন মেলার আয়োজনে দখল। অথচ নিকট অতীতেও এ দৃশ্য কল্পনা করা যেত না। এর বড় একটি কারণ হচ্ছে প্রযুক্তির প্রতি মানুষের আসক্তি। অবসর সময়গুলোতে নিজেকে প্রযুক্তি জালে আটকে রেখে অন্যরকম এক তৃপ্তি নেয়ার চেষ্টা। প্রযুক্তির দোলাচল প্রযুক্তি আশীর্বাদ না কি অভিশাপ তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব এখনও রয়েছে। কেউ বলছেন প্রযুক্তির কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এ সময়ের ছেলেমেয়ে আবার কেউ বলছেন প্রযুক্তির কল্যাণেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ব্যাপারটা আসলে তর্কের নয় বোঝার। অনেক আগে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ রচিত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি টিভিতে প্রচার হওয়া মাত্রই পুরো দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিশেষ নাটকের মূল চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি নিয়ে রীতিমতো তুলকালাম কান্ড বেঁধে যায় দেশে। নির্দোষ ব্যক্তি আইন এবং উকালতির প্যাঁচে পরে ফাঁসিতে প্রাণ দেয়া তে অনেক অ্যাডভোকেট সে সময় বেশ ক্ষেপে যায়। তাদের ধারণা নাটকে উকিলদের নেগেটিভভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু এ প্রশ্নে জবাবে লেখক বলেছিলেন, তিনি নাটকে ভাল এবং চতুর দুই ধরনের উকিলকেই দেখিয়েছেন। তাহলে ভালর পক্ষে সাফাই না গেয়ে কেন ওই চতুর উকিলের পক্ষ নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। এখনকার ব্যাপারটাও ঠিক তাই। মানুষের কল্যাণে যুগে যুগে প্রযুক্তি নিত্যনতুন ভাবে আবির্ভূত হবে। যা মানুষের কল্যাণেই সৃষ্টি। আর প্রত্যেক সৃষ্টির ভাল মন্দ গুণ থাকবেই। দেখতে আমরা কোন টা গ্রহণ করছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সৃষ্টি এ সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর অনেক গ্রহণযোগ্য দিক রয়েছে। যা ব্যবহার করে সহজেই দূর-দূরান্তের মানুষের কাছে আসা যায়। এখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেন্দ্রিক নানা ধরনের ব্যবসায়িক দিকগুলোও উম্মুক্ত হয়েছে। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করে অনেকে নিজেদের তুলে ধরছেন। এতে করে অনেকের সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত হয়েছে। অন্যদিকে মানসম্মত নয় এমন ধরনের প্রোগ্রামও ছেড়ে দেয়া হয় ইউটিউবে। এখন কে কোনটা গ্রহন করবে সেটার ওপর নির্ভর করছে তার মানসিকতা। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুদ হয়ে যায়। এক ধরনের নেশায় যেন আক্রান্ত হয়ে যায়। কথা হচ্ছে এই বুদ হয়ে যাওয়ার আগে এ ব্যাপারটা পরিবারের কেউ কি খেয়াল করছে না? নাকি সন্তান ইউটিউবে কোন চ্যানেলগুলো ভিজিট করবে সেটা লক্ষ্য করা হচ্ছে না? যদি কেউ এভাবে কোন সাইটের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে তার আশপাশের কোন কোলাহল বা আয়োজন আর তাকে স্পর্শ করবে না। অনেক আত্মকেন্দ্রিকতা ঘিরে ধরবে। এক পর্যায়ে সেটাও যখন পানসে হয়ে যাবে তখন তাকিয়ে দেখবে তার চারপাশে কেউ আর নেই। সবাই তাকে রেখেই ব্যস্ত হয়ে গেছে। এবং সে গোল্লায় গেছে এই ভেবে কোন বন্ধু তার কাছে আর থাকেনি। সে থেকে তৈরি হতে থাকে বিষণœতা। উপায় না দেখে আবার সে নতুন সাইটের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং যে কোন সময় ঘটিয়ে ফেলে দুর্ঘটনা। আমরা শুধু এদের দোষ দিয়েই যেন পার পাই। আর দুষতে থাকি প্রযুক্তিকে। কিন্তু সন্তানের এ পর্যন্ত আসার বিষয়টি কখনই সেভাবে খতিয়ে দেখি না। অথচ বড় দুর্ঘটনা এখানেই ঘটে যায়। বাবা মা যদি সচেতন থাকতেন তাহলে সন্তানের এই বুদ হয়ে যাওয়া রোধ করতে পারতেন। এবং সন্তানের এই প্রযুক্তি ব্যবহারের শুরুতেই যদি কোন বাধ্যবাধকতা দেয়া হতো তাহলে এতদূর ঘটনা গড়ায় না। পারিবারিক সংস্পর্শ ও আবহ মানুষকে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। শিশুদেরসহ সবাইকে নৈতিকতায় শিক্ষা দিতে হবে সবার আগে। প্রথম বা আদি প্রতিষ্ঠান পরিবার থেকেই তাদেরকে আদব শিক্ষা দিতে হবে। বর্তমানে এসবের বালাই নেই প্রায় পরিবারে। শিশুদের জন্য অবারিত সুষ্ঠু বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে তারা ভিনদেশী কালচারের দিকে অতিমাত্রায় ধাবিত না হয়। আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের আগডুম-বাগডুম (অহেতুক অনেক সিলেবাস) শেখানো হয়, শেখানো হয় না নৈতিকতা-মানবিকতা, আদব কায়দা-যা বড়ই পরিতাপের বিষয় দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের ‘গোড়াতেই গলদ’। শিক্ষা ও পারিবারিক শিক্ষায় অমূল পরিবর্তন এনে, চরিত্র গঠনোপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে সর্বত্র। তাহলেই সৎ মানুষ গড়ে উঠবে সমাজে। যারা হবে অসহিষ্ণু-সংস্কৃতিমনা-দেশপ্রেমিক। যারা কিনা লিপ্ত থাকবে না কোনরূপ সহিংসতায়। সাংস্কৃতিক জাগরণের মাধ্যমে বুদ্ধি আর বিবেচনায় ভাল মানুষ হয়ে উঠতে হবে সবাইকে। এ কথা ঠিক যে, আমাদের বিনোদন মাধ্যমগুলো আগেকার দিনের মতো আর ভাল মানের হৃদয়গ্রাহী প্রোগ্রামসমূহ উপহার দিতে পারছে না (তবে সবাই না)। সংস্কৃতিক প্রবাহ তো আর বাঁধ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। শুধু নীতিমালা আর ক্ষমতার জোরে বিশ্বায়নের অবাদ সাংস্কৃতিক আটকে রাখা কঠিন। একমাত্র দেশপ্রেম ও মানসম্পন্ন-যুগোপযোগী প্রোগ্রাম দিয়েই তা মোকাবেলা করতে হবে। সাংস্কৃতিক প্রবাহকে ইতিবাচক ধারায় সঞ্চারিত করে দিতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। দেশের প্রকৃত সংস্কৃতি ধারণ করার জন্য সভ্যতা-ইতিহাস-দর্শন-সমাজবিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়বলীর চর্চা বাড়াতে হবে। প্রসঙ্গ যখন ব্লু হোয়েল সম্প্রতি সময়ে একটা ঘটনা বেশ তোলপাড় করে সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে কিশোর কিশোরীদের অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল যা পরবর্তীতে টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। বিষয়টির সূত্রপাত একটি রাশিয়ানভিত্তিক অনলাইন ভিডিও গেম কে কেন্দ্র করে। গেমটির নাম ব্লু হোয়েল। প্রশ্নোত্তর পর্বে আটকে রাখা হয় গেমারদের। এবং প্রতিটি পর্বেই কিছু চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়, যা গেম প্লেয়ারদের পূরণ করে প্রমাণসহ গেম সাইটে আপলোড করতে হতো। যিনি গেম খেলতে বসতেন সুকৌশলে তার কাছ থেকে জেনে নেয়া হতো তার ভাল লাগা মন্দ লাগার ব্যাপারগুলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো যে যেমন মানাসিকতা প্রকাশ করত তার চ্যালেঞ্জগুলো সেভাবেই ছুড়ে দেয়া হতো পূরণ করার জন্য। যেমন কখনও জিজ্ঞেস করা হতো নিজের হাত কেটে তিমি মাছের আকৃতি আকাতে পারবে কি না? দেখা গেছে অনেকেই নিজের হাতকে ক্ষতবিক্ষত করে তিমি মাছ একে তার ছবি তুলে গেম সাইটে আপলোড করত। এমনই বিভিন্ন স্টেজে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ একসেপ্ট করে প্রতিযোগীরা নিজের অজান্তেই গেমটির প্রতি এক ধরনের আসক্তিতে আটকে যেত। যত এগুতে থাকত ততই ভয়ঙ্কর সব চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করতে থাকত। এমনই এক পর্যায়ে বলা হতো বৃষ্টি ভেজা রাতে ছাদের কার্নিশ ধরে হাঁটতে পারবে কি না? এমন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাতে জীবন চলে গেছে অনেক ছেলে মেয়ের। এ অবস্থা যখন ভয়াবহ তখনই টনক নড়ে উঠল সবার। সবাই ভাবতে লাগল ব্লু হোয়েল বুঝি এক মরণনেশা ভিডিও গেম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সব জায়গায় এই গেমটি খেলা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হলো। কিন্তু এর পেছনের যে ইতিহাস তা যেন আরও বেশি ভয়ঙ্কর। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় যেটা বের হয়েছে তা হিসেব নিকেশ করলে দোষটা ব্লু হোয়েল গেম কে না দিয়ে নিজেদেরই দিতে হবে। গবেষণার তথ্য মতে মানসিকভাবে বিষন্ন ছেলে-মেয়েরা এই গেমটার প্রতি বেশি ঝুঁকেছে। এর মূল কারণ নাকি তাদের মানসিক বিষাদ দূর করা। প্রশ্ন হলো এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের এত মানসিক বিষাদ এলো কোথা থেকে। এর উত্তর যেন আরও কষ্টদায়ক। মূলত বাবা মায়ের থেকে সন্তানদের মাঝে দূরত্বই নাকি এই বিষণœতা সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ বাবা মা উভয়ই নিজ নিজ পেশাতে এতটাই মগ্ন থাকে যে সন্তানদের ওপর নজরদারী কিংবা প্রতি সময়ে খোঁজ নেয়ার সময় হয় না। যে কারণে সন্তানদের চাওয়া পাওয়া তাদের জানা হয়ে ওঠেনি। ফলাফল, পূরণ হয়নি সন্তানদের ইচ্ছা আকাক্সক্ষা। সেখান থেকেই দূরত্বের সৃষ্টি। অন্যদিকে বাবা মা তাদের সন্তানদের অবসর সময়ে ব্যস্ত রাখতে বিভিন্ন প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে থাকে তাদের পরিবারে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্ট ফোনে তাদের ব্যস্ত থাকার কৌশল নিজের অজান্তেই ছেলে মেয়েদের শিখিয়ে দিচ্ছে। তাদের ধারণা বাবা মা বাসায় না থাকার অভাব যেন ছেলে মেয়ে বুঝতে না পারে। কিন্তু একটা পর্যায়ে এই ছেলেমেয়েগুলো বাবা মা’র চিন্তা বাদ দিয়ে প্রযুক্তির দিকেই ঝুঁকে গিয়ে তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে। আর এক পর্যায়ে আসক্তির সৃষ্টি হয় সেসব প্রযুক্তির মধ্যে। এভাবেই একটু একটু করে বুদ হয়ে যায় তারা প্রযুক্তির প্রতি। একটা সময় নাওয়া খাওয়া ভুলে যায়। সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের মানুষের মনজগত বিচিত্র আরও বিচিত্র তাঁর চিন্তা জগৎ ও মানুষের আচরণ। আমাদের বুঝতে হবে, কম্পিউটার- ফেসবুক-ইন্টারনেট চালাতে পারলেই মানুষ মহা স্মার্ট হয়ে যায় না। হ্যাঁ প্রযুক্তি আমাদের প্রয়োজন কিন্তু অন্যদিকে আত্মার চাহিদা ও সমাজ বাস্তবতাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। একথাও মনে রাখতে হবে, উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছালেও সেখানে মূল্যবোধ, মানবিকতা না থাকলে তা সে সভ্যতা অস্তিত্বহীন হয়ে পরবে। অভিভাবকদের সম্পদের পিছনে না ছুটে সন্তানকে সময় দিতে হবে। যে সন্তানের ভবিষ্যত নির্ধারণ করার জন্য এত কষ্ট করছেন সেই সন্তানই যদি স্বাভাবিক মানুষ না হয়ে বড় হয় তাহলে সে সম্পদ কোন কাজেই আসবে না। কারণ অতি প্রিয়জনের মমতার স্পর্শ অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়। আমাদের পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সঙ্গী ও সুযোগের খুব অভাব রয়েছে। সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে বাবা-মাদের। বাবা-মায়েদের গুরুত্ব দিতে হবে সন্তানের ইচ্ছা আকাক্সক্ষাকে। এছাড়া নিজেদের কোন সিদ্ধান্ত সন্তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। এতে করে সন্তান বেঁকে বসতে পারে। শত ব্যস্ততার মাঝেও খোঁজ রাখতে হবে সন্তান কখন কি করছে কার সঙ্গে মিশছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ভিডিও গেম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ইউটিউবে ব্যয় করছে কি না সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। সকালের সূর্যের আলোকছটায় এখন আর আমাদের ঘুম ভাঙে না, আমাদের ঘুম ভাঙে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন নোটিফিকেশনের আওয়াজে। কিছুকাল আগেও আমরা নাশতার টেবিলে পরিবারের সকলের সঙ্গে চা খেতে খেতে পত্রিকায় একটু চোখ বুলিয়ে নিতাম, কিন্তু এখন আর সকলের সঙ্গে নাস্তাও করা হয় না, পত্রিকায় চোখ বুলানোও হয় না। যদিও প্রযুক্তির কল্যাণে পত্রিকাও এখন আমাদের হাতের মুঠোয় তারপরও পত্রিকা দেখা বা পড়ার সময় কোথায় আমাদের? আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা যখন দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন আমরা নাশতার টেবিলে বসে মোবাইলে নোটিফিকেশন দেখছি। তারপর চ্যাটিং করতে করতে যখন জোহরের আজান হয় তখন ‘ঠা-া’ চাটুকু পান করে ল্যাপটপ অথবা কম্পিউটারে গিয়ে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের চরম সামাজিক মনোভাব প্রকাশ করছি। প্রযুক্তি অভিশাপ দূরীকরণে প্রতিটি সচেতন অভিভাবকদের প্রযুক্তির সংস্পর্শে আসতে হবে। সন্তান কি করছে, কোন ওয়েবসাইটে ভিজিট করছে, কম্পিউটারকে বিনোদনের মাধ্যম না জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছে, কত সময় ধরে কম্পিউটার ব্যবহার করছে ইত্যাদি বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দিনের পর দিন নতুন নতুন ওয়েবসাইট তৈরি হচ্ছে। মেধা খরচ করে তৈরি করা ওয়েবসাইটগুলোতে শিক্ষা, চিকিৎসা, বিজ্ঞান, বিনোদন, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় স্থান পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রযুক্তি পণ্য স্বল্পমূল্যে বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষণীয় ওয়েবসাইটও তৈরি করতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরীর পাশাপাশি কম্পিউটার ল্যাবে রক্ষিত কম্পিউটারের তথ্য ভা-ার বিখ্যাত বইয়ের ই-বুক দিয়ে ই-বুক লাইব্রেরী গড়ে তুলতে হবে। সরকারী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণকৃত বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রোগ্রামগুলোই দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে ইচ্ছেমত বা অপ্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম ইনস্টল করতে বা রিমুভ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কিন্তু পড়াশোনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রয়োজনীয় সাইটগুলোর ঠিকানা ব্যতীত অন্য কোন সাইটে প্রবেশ করতে যেন না পারে সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। প্রকৃত অর্থে এমন নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা উচিত যাতে করে শিক্ষার্থীরা পথভ্রষ্ট, অমনোযোগী না হয়, এতে করে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেকাংশেই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটমান প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে ‘প্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ’ এ বিতর্কে না জড়িয়ে প্রযুক্তি দেশ ও জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে কিভাবে ধরা দিবে, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সবাই আলোকিত হবে, এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। প্রযুক্তি প্রকৃত মানবকল্যাণে ব্যবহার হোক।
×