ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

নীরব ঘাতক অতিরিক্ত আলো ও শব্দ দূষণ

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ৫ নভেম্বর ২০১৮

 নীরব ঘাতক অতিরিক্ত আলো ও শব্দ দূষণ

অবাঞ্ছিত কোন শব্দ, যা পরিবেশ এবং মানুষ বা অন্য কোন জীবের ভারসাম্য বিনষ্ট করে তাকেই আমরা শব্দ দূষণ বলে থাকি। শব্দ দূষণের ফল তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না। এটি সাধারণত পরোক্ষভাবে এবং ধীরে ধীরে মানব শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে। শব্দ দূষণের প্রধান শিকার মানুষের কান। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ শব্দের মধ্যে অবস্থান করলে মানুষের শ্রবণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। এতে ঢাকার ব্যস্ত রাস্তার আশপাশে নিয়মিতভাবে কর্মরত ব্যক্তিদের শ্রবণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, মানুষের কানই শব্দ দূষণের একমাত্র শিকার নয়। শব্দ দূষণের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের উচ্চরক্তচাপ দেখা দেয় এবং বেড়ে যায় হৃদযন্ত্রের কম্পন। সাময়িকভাবে অনেকের মাথা ঘুরা বা বমি বমি ভাব দেখা দেয়। শব্দ দূষণের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও তাৎপর্যপূর্ণ। এর ফলে বাড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। মানুষের মেজাজ হয় খিটখিটে। কোলাহলকে সংজ্ঞার দিক দিয়ে দেখলে বলা যায় অপ্রয়োজনীয় শব্দ। এটি ক্রমশ বাড়ছে। বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে এটি একটি প্রধান ভূমিকা নেয়। শব্দ বায়ুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় ফলে বাতাসের গুণমান দিয়ে এর প্রভাব বোঝা যায়। শব্দ মাপা হয় ডেসিবল দিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রতিনিয়ত ৯০ ডেসিবলের ওপর শব্দ উদ্গিরণ হলে তা শোনার ক্ষমতার ওপর বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং স্নায়ুতন্ত্রের ওপর পাকাপাকি প্রভাব ফেলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) একটি শহরের ক্ষেত্রে ৪৫ ডেসিবলকে নিরাপদ শব্দমাত্রা হিসাবে স্থির করেছে। ভারতে মেট্রোপলিটান এলাকায় শব্দের মাত্রা অনেক সময়ই গড়পড়তা ৯০ ডেসিবলের বেশি থাকে। বিশ্বের মধ্যে কোলাহলের দিক দিয়ে মুম্বাইকে তৃতীয় দূষিত শহর হিসাবে গণ্য করা হয়। দিল্লী তার খুবই কাছাকাছি রয়েছে। শব্দ দূষণ কেবল অস্বস্তি বা বিরক্তি বাড়ায় তা নয়, এর ফলে ধমনীর গতিপথও রুদ্ধ হয় এবং এ্যাড্রিনালিন প্রবাহ বৃদ্ধি করে যা কিনা হৃদযন্ত্রকে দ্রুত কাজ করতে বাধ্য করে। ক্রমাগত শব্দ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এর ফলে ধমনীর পাকাপাকিভাবে ক্ষতি হয় যে কারণে হার্ট এ্যাটাক বা স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, অতিরিক্ত শব্দ নিউরোসিস এবং নার্ভাস ব্রেডকাউনেরও কারণ। শব্দ প্রাণিকুলের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু এর সীমা থাকা দরকার, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবল (শব্দের নিম্নতম পরিমাপক) সাময়িকভাবে শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দেয় আর ১০০ ডেসিবেল শব্দ হলে চিরতরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। রাজধানী ঢাকার অনেক স্থানে ১০৭ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ থাকে বা আছে। শব্দ দূষণের সঙ্গে বধিরতার সম্পর্ক রয়েছে। আকস্মিক তীব্র শব্দ কানের ভয়াবহ ক্ষতি করে। সম্পূর্ণ বধিরও করতে পারে। আমাদের যানবাহন ও শিল্প-কারখানা থেকে ভয়াবহ শব্দ দূষণ হয়। শব্দ দূষণের ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়া রোগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট, মাথা ধরা, বমি বমি ভাব ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। একটানা গাড়ির শব্দ বা উচ্চ শব্দ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। পুরো ঢাকা শহরটাই এখন ভয়াবহ শব্দ দূষণের শিকার। বিশ্বে উৎপাদিত বিদ্যুতের এক-চতুর্থাংশ কৃত্রিম আলো তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বলে বিজ্ঞানীরা বলছেন। অতিরিক্ত আলোর এলাকায় বিলবোর্ডের আলোর ঝলকানিতে গাড়ির চালক নিশানা ভুল করতে পারেন। আলোকসঙ্কেত নাও দেখতে পারেন। আমাদের রাজধানীর বা বড় শহরের রাস্তার দু’ধারে অনেক আলোক বিলবোর্ড আছে। কৃত্রিম আলোর জন্য যে শক্তি ব্যবহার করা হয়, তার ৩০-৬০ ভাগ পর্যন্ত অপচয় হয় বলে জানা যায়। সড়কবাতি, বিলবোর্ড ইত্যাদি ব্যবহারের প্রয়োজনে আলো যাতে কম ছড়ায়, তা খেয়াল রাখতে হবে। অনেক দেশেই আবিষ্কৃত (যেমন জার্মানি) হয়েছে লক্ষ্যবস্তুতে আলোকিত করার বাল্ব। এতে চারদিকে আলো ছড়িয়ে যাবে না। কিন্তু আমাদের অনেক অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য থাকে লোক দেখানো বা জাঁকজমক করা। এতে আলোর অপচয় হবে। আলো দূষিত হবে। সচেতনতাই কেবল পারে আমাদের দেশে শব্দ দূষণ ও আলোক দূষণ কমাতে। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আমরাও এগিয়ে আসব। ব্যর্থ হলে আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই খারাপ হবে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ এ বলা হয়েছে, শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব ও ক্ষতিকরের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার কথা বলা আছে। আইনে বলা আছে, প্রতি ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন বা নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কী কী করবে। এসব কর্তৃপক্ষের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকা শনাক্ত করতে হবে। যেমন নীরব এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, মিশ্র এলাকা, শিল্প এলাকা, আবাসিক এলাকা প্রভৃতি। নীরব এলাকায় থাকবে হাসপাতাল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত হবে। ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা আছে, যা কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। শিল্প এলাকায় কম শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে হবে। যন্ত্রপাতিগুলো নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যথাসম্ভব মাইকের ব্যবহার কম করতে হবে। এড়িয়ে চলতে পারলে খুব ভাল হবে। না হলে কম শব্দ সৃষ্টি করে এমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। জাপানীরা বা উন্নত দেশের লোকরা কথা কম বলেন। কাজ বেশি করেন। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। আমরা ধীরে ধীরে এ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারি। এদিকে কৃত্রিম আলোতে বিশ্ব ভরে গেছে। বাংলাদেশও সেপথে। শহরে রাত আর দিনের পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে অনেক সময়। অনেক শহর কৃত্রিম আলোয় দিনের ফ্লেভার পায়। উন্নত দেশের বেশিরভাগ শহর তো এ রকমই। কায়রোকে তো বাজারের শহর বলা হয়। রাতের বেলায় জাঁকজমক বেশি হয়। বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলো এমনকি জেলা বা মফস্বলের অনেক শহরে আলোর খেলা চলে রাতে। কসমেটিক বা বিপণি কেন্দ্রগুলোয় রাতেই উপচেপড়া ভিড় হয়। কর্মব্যস্ত মানুষ রাতেই বাজার বা মার্কেট করতে চাই। বাচ্চারাও কৃত্রিম আলোর নাচুনিতে মুগ্ধ হয়ে অভিভাবকদের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রভাবিত করে। এ সংখ্যা এখন বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া কৃত্রিম আলো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাদুড়, লক্ষ্মীপেঁচা, হুতুমপেঁচা, শিয়াল, বনবিড়াল প্রভৃতি প্রাণীর চলাচলে বিঘিœত সৃষ্টি করে। বংশবিস্তার কমে যায়। সোডিয়াম আলোর কারণে অনেক প্রাণী বাসস্থানের পরিবেশ নষ্ট হয়। আলো দূষণ ও শব্দ দূষণ নিয়ে আলোচনা একেবারেই কম। কিন্তু এ দুটো দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য নীরব ঘাতক। উন্নয়নের গতির সঙ্গে সঙ্গে এ দূষণ বাড়ছে। মানুষ্যসৃষ্ট কারণেই ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় কারণে বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হচ্ছে। অধিক ভোগ-বিলাসীতার জন্য আলো দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে শব্দ দূষণের মাত্রা উর্ধমুখী। আলো দূষণ উন্নত বিশ্বে বেশি। শব্দ দূষণ নীতিমালা অনুযায়ী শুধু নীরব এলাকা নয়, আবাসিক, বাণিজ্যিক, মিশ্র, শিল্প এলাকাও চিহ্নিত করে স্ট্যান্ডার্ড সঙ্কেত বা সাইনবোর্ড স্থাপন করতে হবে। কিন্তু তা শুধু নীতিমালাতেই রয়ে গেছে, বাস্তবায়ন নেই। জনসচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারের পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতর, স্থানীয় সরকার, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর ন্যস্ত আইনসিদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য আন্তরিকতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন এবং বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। [email protected]
×