ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

সামাজিক যোগাযোগ ও মানবতার ভিন্ন রূপ

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৪ নভেম্বর ২০১৮

সামাজিক যোগাযোগ ও মানবতার ভিন্ন রূপ

আসন্ন নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগের ব্যবহার বিশেষ করে ফেসবুকের ব্যবহার নিয়ে (টুইটার, মাই স্পেস, ইন্সটাগ্রাম বা অন্য মাধ্যমগুলো আমাদের দেশে এখনও তেমন জনপ্রিয় হয়নি) নানারকম আলোচনা, বিতর্ক চলছে। এই আলোচনা নিরর্থক নয়, কারণ ফেসবুক আমাদের ডিজিটাল মানসে এক নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে বা প্রভাব ফেলেছে। এর সর্বগ্রাসী রূপে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এমনকি জাতীয় পর্যায়ে অনেক নতুন নতুন ঘটনার জন্ম হয়েছে ও হচ্ছে। পরিবর্তনশীল সমাজে রূপান্তরের নানা কৌশল অনিবার্যভাবেই উন্নয়নের চলমান যাত্রায় যুক্ত হয়, যার অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্য আমরা প্রাথমিক বিবেচনায় অনুধাবন করতে পারি না। সামাজিক মাধ্যমের অনেক রূপ দুনিয়াব্যাপী পরিচিত হয়েছে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে ফেসবুক ও টুইটার। আমাদের দেশ পত্র-মিতালির দেশ, সেই কবুতরের ঠোঁটে পাঠানো চিঠির আমল থেকে আমরা ‘ভুলো না আমায়’ খ্যাত হালকা রঙিন খামে আঁকাবাঁকা হরফে চিঠি লিখেছি। অজানা-অচেনা মানুষের সঙ্গে মিতালি করেছি আর সেই মিতালি নিয়ে কোনদিন মামলা হয়েছে এমন ঘটনার কথা কেউ কখনও শোনেনি, এমনকি হয়ত কল্পনাও করতে পারেনি। বাঙালীর ভাব-জগতের যে আবেগ সে তার চিঠিতে প্রকাশ করত। তা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী মিলিয়েছিলেনÑ ‘সমুখে রয়েছে সুধা পারাবার, নাগাল না পায় তবু আঁখি তার, কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধা রে।’ এই কুহেলিকামাখা বাধা বাঙালী সরাতে পারেনি আজও। তাই কল্পনার জগতে বসবাস করে সে এখনও ভুল বাক্য প্রয়োগ করে তার ভাবনাশক্তির ভুল ব্যবহার করে। চিঠির যুগ আজ প্রায় শেষ। সেখানে এসে যুক্ত হয়েছে ই-মেইল, টেক্সট মেসেজ। আজকাল নানারকম এ্যাপ ব্যবহার করে মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে, হয়ত কথা বলতে, নয়ত লিখতে। প্রযুক্তির ভাষায় এই কথাকে আমরা ভয়েস আর মাধ্যমকে ডাটা বলি, ইন্টারনেট যার অন্যতম। ফলে যোগাযোগের নতুন নতুন মাধ্যম এসে হাজির হয়েছে আর সমাজে শ্রেণী, শিক্ষা ও মর্যাদার বৈষম্য থাকার কারণে আমরা এক সঙ্গে সবাই সেসব আধুনিক প্রযুক্তি শিখে নিতে পারছি না। তার ফলশ্রুতি হলো ভুল বোঝাবুঝি, মিথ্যালাপ ও সত্য-মিথ্যার মিশেলে এক ‘কুহেলিকা’ সমাজে আমরা উপস্থিত হয়েছি। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি এই নিয়ে পণ্ডিতদের আলোচনার শেষ নেই। খুব সহজে যদি আমরা সোশ্যাল মিডিয়া বলতে কী বুঝি তা একটু আলোচনা করে নেই তাহলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হবে এর মধ্যে সাধারণ মানুষের সংযোগ কি? আমরা সবাই জানি, ইন্টারনেটের যুগে আমাদের যা কিছু করতে হয় তার একটি ভার্চুয়াল ঠিকানা বা অবস্থান থাকতে হয়। খুব জটিল করে না দেখে আমরা যদি বলি ‘ওয়েব’ তাহলে বোঝা যাবে এই ওয়েব একটি ঠিকানার মাধ্যমে আমার কাছে হাজির হয়েছে। প্রযুক্তির ভাষায় এই ঠিকানাকে বলে টিএলপি বা টপ লেভেল ডোমেইন (যেমন ডটকম, ডটনেট, ডটঅর্গ ইত্যাদি) আর তা বহন করে আইপি (ইন্টারনেট প্রোটোকল), যা একটি সংখ্যাগত পরিচয়। এই আইপি আমরা একা ব্যবহার করতে পারি বা কয়েকজন মিলেও শেয়ার করতে পারি (যেমন অনেকে শুনে থাকবেন ‘আমার রিয়েল আইপি’ আছে আবার কেউ বলেন ‘আমাদের শেয়ার আইপি’ আছে ইত্যাদি)। সেই ওয়েবের ঠিকানা আমাদের চোখের সামনে হাজির হয় নানারকম সুবিধা নিয়ে। যেমন কারও কাজের তথ্য, কী কী কাজ করেন তার বিবরণ আর এই তথ্য যতক্ষণ তিনি পরিবর্তন না করবেন ততক্ষণ একইরকম বা অপরিবর্তনীয় থাকবে। অপরদিকের একটি সুবিধা হলো ওই ওয়েবেরই আর এক ধরনের প্রযুক্তি, যা আমরা কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট থাকলেই দেখতে পাই ও চাইলেই আমরা আমাদের নিজেদের তথ্য সেখানে বিনিময় করতে পারি। এই দ্বিতীয় প্রযুক্তি সুবিধা নিয়েই জন্ম হয়েছে সামাজিক মাধ্যমের, যা বিশেষত জায়গা করে নিয়েছে স্মার্টফোন ও ট্যাবে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে কোন ব্যবহারকারী খুব সহজেই কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য, দলবদ্ধ বা গ্রুপ করে মতবিনিময় বা এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার সংযোগ ঘটিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি করে নিতে পারে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন আমাদের এখন এমনও সুবিধা দিয়েছে যে, আগে থেকে কিছু না লিখে আমরা সরাসরি ইন্টারনেট ব্যবহার করেও লিখে দিতে পারি, এঁকে বা ভিডিও বা ফটো যোগ করে দিতে পারি, যা সঙ্গে সঙ্গে শত সহস্র মানুষ দেখে নিতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো, প্রযুক্তি আমাদের যেসব সুবিধা এনে দিয়েছে তাতে আমি কখন কোন্ মাধ্যমে কী কাজে ব্যবহার করব বা সোজা কথায় কী লিখব বা জানাব। এই লেখা, জানানো, ছবি দেয়া বা ভিডিও যুক্ত করা এসবকেই সহজভাবে প্রযুক্তির ভাষায় আমরা বলি ‘কন্টেন্ট’। আমি আগেই উল্লেখ করেছি, আমাদের সমাজে নানারকম বৈষম্য (প্রধানত শ্রেণী, শিক্ষা ও মর্যাদার) থাকার ফলে আমরা সবাই মিলে এক সঙ্গে প্রযুক্তির সুবিধাগুলো বুঝে উঠতে পারিনি। ফলে যারা খুব ভাল বুঝে তারা যেভাবে ব্যবহার করে, যারা ভাল করে বোঝেনি বা শিখেনি তারা সঙ্গত কারণেই ভালভাবে এসবের ব্যবহার করায়ত্ত করতে পারেনি। আর সেখানেই বেধেছে বিপত্তি। ভুল কথা লিখে, ভুল ছবি দিয়ে বা ভুল মন্তব্য করে আমাদের অনেককে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছে, তিরস্কৃত হতে হয়েছে, এমনকি সমাজে ও পরিবারের নানারকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। আমাদের প্রযুক্তি শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন শিক্ষার সমন্বয়ের অভাব এসব ত্রুটির একটি বড় কারণ। আমরা যখন শিক্ষাকে নানারকম নীতিমালার মোড়কে সাজাই তখন সমাজে এর প্রভাব নিয়ে ভাবি না। আমরা গুরুত্ব দেই শিক্ষার্থীদের ফলাফলের দিকে। ফলে সমাজের শিক্ষার প্রভাব বা পরিবারে বা ব্যক্তি জীবনে শিক্ষার যথাযথ প্রয়োগ যে অনিবার্য সে জ্ঞানের অভাবে আমরা নতুন এক বিভক্তি তৈরি করছি। যার কারণে সামাজিক মাধ্যম আমাদের চোখে এখন এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ রচনার মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের সজাগ ও জাগ্রত থাকা যেন এসব ফেসবুকের সব কথায় আমরা বেশি একটা কান না দেই। আমাদের আগে বুঝে নিতে হবে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য কি এবং কোথা॥ প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের সেই শিক্ষা না দিলেও এই ইন্টারনেটেই বিস্তর শিক্ষা ছড়িয়ে আছে। আমাদের সরকারী সাইটগুলোতে গেলে জানা যাবে আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারের নীতিমালা, জানা যাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে ধারণা, পাওয়া যাবে দুনিয়ার কোথায় কি ঘটছে আর আমাদের জন্য কোন্ বিষয় জরুরী। আজকাল অনেক অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সেসবের কিছু সংবাদ অনেকক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যার মিশেল দেয়া থাকে। আমাদের অনুধাবন করতে হবে আমি সেটা কেন বিশ্বাস করব? তখন আরও কয়েকটি অনলাইনে সংবাদ দেখলেই তা যাচাই করে নেয়া যাবে। টেলিভিশনগুলো সংবাদ প্রচার করে। যতই তাদের নিজস্ব মত থাকুক, কিন্তু সত্যের অপলাপ করার সুযোগ সেখানে নেই। মিলিয়ে দেখা যেতে পারে সেসবও। তারপর চিন্তা করা যেতে পারে কোন্ বিষয়টি আমার বিবেককে নাড়া দিয়েছে আর দশজনের তা জানা দরকার। তখন আমি সেই সংবাদের বিষয়বস্তু নিয়ে কিছু লিখতে পারি (আমরা যাকে স্ট্যাটাস বলি) বা যাকে আমি আমার বিবেক ও যুক্তি দিয়ে সঠিক এবং আইনসঙ্গত মনে করেছি তার লিঙ্ক শেয়ার দিতে পারি। আমার যদি সে সুযোগ থাকে তাহলে কেন হুটহাট করে, আমি একটা কিছু লিখে বসব, যা আমার ও আরও দশজনের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে? আমরা অনুমান করছি আমাদের সামনের নির্বাচনে ব্যাপকভাবে আমরা ফেসবুকের ব্যবহার করব, বিশেষ করে প্রচারের কাজে। ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাদের এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে জাতি হিসেবে আমরা মিথ্যাবাদী ও অজ্ঞান বলে অন্যের দরবারে পরিচিত হই। এখন যে যুগ চলছে তা হলো জ্ঞান সমাজের। সেখানে আমাদের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া হবে জ্ঞানীর মতো, ধীরস্থির, কোনভাবেই যেন অস্থির প্রলাপ দিয়ে আমরা আমাদের ফেসবুকের পাতা ভরিয়ে না তুলি। ভুল কথা লিখে বা প্রচার করে আমরা যদি আইনের চোখে অপরাধী হই আর তার সংখ্যা যদি দিন দিন বাড়তেই থাকে তাহলে অন্য দেশগুলো যখন সেটা জানতে পারবে তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে থাকবে। পরিবারগুলো অসম্মানবোধ করবে, ভাই-বোনেরা সমাজে মাথা নিচু করে চলবে। এটা নিশ্চয়ই আমাদের কারও কাম্য নয়। আমরা গত দশ বছরে অনেক কিছু অর্জন করেছি। অজ্ঞানতার জগত মাড়িয়ে আমরা জ্ঞান সমাজে প্রবেশ করে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করতে সমর্থ হয়েছি। পৃথিবীর অনেক দেশ আমাদের এখন অনুসরণ করছে বা আমাদের এসব সাফল্য কেমন করে এলো সে নিয়ে ভাবছে। ফেসবুক বা সামাজিক মাধ্যমে আমরা সেসব নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করতে পারি, আমাদের সাফল্যগাথা তুলে ধরতে পারি, এমনকি সামনের দিনে আমরা কী করব, কিসে আমাদের মর্যাদা বাড়বে সে নিয়ে মতের আদান-প্রদান করতে পারি। সে বুদ্ধি আমাদের তরুণ সমাজের আছে। সবাই মিলে তখন গর্ব করতে পারব আমরা এমন কিছু করছি না যা আমাদের নিজেদের ও দেশের জন্য অসম্মানজনক। কোথায় কী করলে আমাদের স্কুলের, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের, বাজারের, পাড়ার বা গ্রামের আরও উপকার হবে সেই কথা জানিয়ে আমরা ফেসবুকে একটা আন্দোলনের সাড়াও ফেলতে পারি। তাতে আমাদের সকলের উপকারই হবে, দেশেরও সম্মান বাড়বে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×