ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি

দুয়ারে কড়া নাড়ছে শীত, গাছিদের দিন কাটছে ব্যস্ততায়...

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৩০ অক্টোবর ২০১৮

দুয়ারে কড়া নাড়ছে শীত, গাছিদের দিন কাটছে ব্যস্ততায়...

সাজেদ রহমান ॥ ‘ঠিলে ধুয়ে দে, বউ গাছ কাটতি যাবো/ঠিলে ধুয়ে দে, বউ গাছ কাটতি যাবো/ খাজুর গাছে চমর বেরোইছে তোরে আইনে দেবো/ খাজুর গাছে চমর বেরোইছে তোরে আইনে দেবো/ সন্ধেয় নস ঝাইরে এনেয় জাউ নান্দে খাবো/ ঠিলে ধুয়ে দে, বউ গাছ কাটতি যাবো/ ঠিলে ধুয়ে দে, বউ গাছ কাটতি যাবো’... যশোর অঞ্চলের এটা বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় গান। গানটি মূলত যশোরের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য স্ত্রী এবং খেজুর গাছকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক গান। শীতের সময় প্রায় সব গানের অনুষ্ঠানে গানটি স্থানীয় শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। সেই খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের সময় শুরু হয়ে গেছে। যশোরের খেজুর গাছ মালিকরা এখন রস পাওয়ার জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। যশোর জেলার অনেক বিখ্যাত জিনিসের মধ্যে খেজুরের রস ও গুড় অন্যতম। এজন্য এ অঞ্চলে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস।’ দিন বদলের সঙ্গে যশোরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়নি খেজুরের রস সংগ্রহ এবং গুড়-পাটালি তৈরির পদ্ধতি। শীত মৌসুমের আগমনে ‘গাছিরা’ খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য প্রাথমিকভাবে গাছ প্রস্তুত করতে হয়। গাছ প্রস্তুতের পরে শুরু হয় রস সংগ্রহ। চিরাচরিত সনাতন পদ্ধতিতে মাটির হাঁড়িতে (ঠিলে) রাতভর রস সংগ্রহ করা হয়। ভোরের সূর্য ওঠার আগে ‘গাছিরা’ রস ভর্তি মাটির হাঁড়ি/ভাঁড় গাছ থেকে নামিয়ে জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরি করে। যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ইতোমধ্যে গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে। অল্প দিনের মধ্যে বাজারে নতুন খেজুর গুড়-পাটালি পাওয়া যাবে। আগামী নবেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর গাছ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হবে গুড়-পাটালি তৈরির উৎসব। গ্রামে গ্রামে পিঠা, পায়েশ, মুড়ি-মুড়কি ও নানা রকমের মুখরোচক খাবার তৈরি করার ধুম পড়ে যাবে। সকালে এবং সন্ধায় কাঁচা রস খেতে খুবই মজাদার। রসে ভেজা কাঁচি পোড়া পিঠার (চিতই পিঠা) স্বাদই আলাদা। নলেন, ঝোলা ও দানা গুড়ের সুমিষ্ট গন্ধেই যেন অর্ধ ভোজন। রসনা তৃপ্তিতে এর জুড়ি নেই। ব্রিটিশ আমলে খেজুর গুড় থেকে চিনি তৈরি করা হতো। এই চিনি ‘ব্রাউন সুগার’ নামে পরিচিত ছিল। খেজুরের রস থেকে উন্নতমানের মদও তৈরি করা হতো। এই চিনি ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালান যেত। চিনির কারখানাগুলো চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুর শহরের আশপাশে কেন্দ্রীভূত ছিল। যশোরের ইতিহাস থেকে জানা যায় চৌগাছা এবং কোটচাঁদপুর-এর আশপাশে প্রায় পাঁচ শ’ চিনি কারখানা গড়ে উঠেছিল। তখন কলকাতা বন্দর দিয়ে খেজুর গুড় থেকে উৎপাদিত চিনি রফতানি করা হতো। খেজুরের গুড় থেকে চিনি তৈরি না হলেও এখন পর্যন্ত বাঙালীর কাছে খেজুর গুড়-পাটালির কদর কমেনি। তবে বিজ্ঞানের এই যুগে এখনও রস থেকে গুড়-পাটালি তৈরিতে প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। গুড়-পাটালি তৈরিতে আধুনিকতা আনা গেলে এটিও রফতানি পণ্যের তালিকায় স্থান পেত। অবশ্য খেজুর গাছ অন্য গাছের মতো বপন করা বা সার মাটি দিতে হয় না। প্রাকৃতিক নিয়মেই মাঠে পড়ে থাকা খেজুর ফল (বিচি) থেকে চারা জন্মায়। সৃষ্টি হয় খেজুরের বাগান। বর্তমান খেজুর গাছ ইটভাঁটির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় বেশ আগের থেকে এ অঞ্চলে গুড়, পাটালির উৎপাদন বহুলাংশে কমে গেছে। এখন আর আগের মতো মাঠ ভরা খেজুর বাগানও নেই, এখন আর চোখে পড়ে মাঠে মাঠে রস জ্বালানোর দৃশ্য। বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে গাছিরা গাছ পরিষ্কার বা তোলা চাচার উপকরণ গাছি দা, দড়ি তৈরিসহ ভাঁড় (মাটির ঠিলে) ক্রয় ও রস জ্বালানো জায়গা ঠিক করাসহ বিভিন্ন কাজে রয়েছে ব্যতিব্যস্ত। যশোরের চৌগাছার চাঁদপাড়া গ্রামের বিশ্বাস আমিনুর রহমান, বাদেখানপুর গ্রামের গিয়াস উদ্দীন, গুয়াতলী গ্রামের চান্দালী জানান, গাছ কাটা, রস জ্বালানো ও গুড়, পাটালি তৈরির উপকরণের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার গত বছরের তুলনায় গুড়-পাটালির দাম দ্বিগুণ হবে।
×