ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনকালে দেশ অস্থিতিশীল করার আশঙ্কায় এই বিশেষ অভিযান

শীঘ্রই দেশজুড়ে শুরু হচ্ছে উদ্ধার অভিযান ॥ আন্ডারওয়ার্ল্ডে ৪ লাখ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

শীঘ্রই দেশজুড়ে শুরু হচ্ছে  উদ্ধার অভিযান ॥ আন্ডারওয়ার্ল্ডে ৪ লাখ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র

শংকর কুমার দে ॥ আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খুব শীঘ্রই দেশব্যাপী আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান শুরু হচ্ছে। মাদকবিরোধী অভিযান চলমান রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর দেশব্যাপী সন্ত্রাসী, অপরাধী ধরতে ও আগ্নেয়াস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ জন্য বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রধারীদের আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমাদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হবে। নির্বাচন কালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, স্বাভাবিক ও নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে এ বিশেষ অভিযান পরিচালিত হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে অস্ত্রের ঝনঝনানি বৃদ্ধির আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর অবস্থানে না গেলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এসব অবৈধ অস্ত্র ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সীমান্ত গলিয়ে চোরাইপথে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদের চোরাচালান এবং জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ ঘটার আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আন্ডারওয়ার্ল্ডে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ যোগ হয় করে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণসহ নানা অপরাধের উদ্দেশ্যে আন্ডারওয়ার্ল্ডে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগান আসে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা নতুন আসা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদে দেশে অস্থিতিশীল ও অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করানো হতে পারে। জঙ্গী সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত চক্র গড়ে তুলছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের ভান্ডর। এ কারণে শীঘ্রই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। সীমান্তে সতর্কতা ও নজরদারি বাড়ানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হচ্ছে বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর ও ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার (বিডিপিসি) গবেষণাসূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে ৪ লাখের মতো। প্রতিবছর দেশে হাজার কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসে চোরাচালানি সিন্ডিকেট। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সিন্ডিকেটের সংখ্যা প্রায় ১২৮। প্রায় ত্রিশটি সীমান্ত পথে এসব আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসছে অস্ত্র চোরাচালানি সিন্ডিকেট। অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানির সঙ্গে জড়িত রয়েছে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র ও চোরাকারবারিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, অস্ত্রধারী ও গডফাদারদের তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সাল পর্যন্ত সারাদেশে সাড়ে ৫ হাজার অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের বিপরীতে ২ হাজার ২০৮ মামলা হয়। তবে উদ্ধার বা আটকের অধিকাংশ মামলাই বিচারাধীন। মামলার দীর্ঘসূত্রতায়, বিচারে ধীরগতি ও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিচার হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেন, দেশে কত অবৈধ অস্ত্র রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টারের (বিডিপিসি) গবেষণাসূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের ১২৮ সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে ৪ লাখের মতো। ওই গবেষণাসূত্রে আরও জানা যায়, আফগানিস্তান বাদে সার্ক দেশগুলোয় ২৫ হাজার কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র আছে, যার পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাকারবারিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করে। বাংলাদেশে এ সিন্ডিকেট প্রতিবছর ৫শ’ কোটি টাকার অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আসে। গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ায় যত অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে, তাতে এটা নিশ্চিত যে দেশের অভ্যন্তরে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকেছে। জঙ্গীদের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। হলি আর্টিজানে হামলাকারী জঙ্গীরা আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য এতে কোন সন্দেহ নেই। আত্মঘাতী স্কোয়াডের এই সদস্যরা যেসব অস্ত্র এনেছিল তারা জানত এসব অস্ত্র তাদের আস্তানায় আর ফিরবে না। সীমান্ত পথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সহজেই দেশে আনছেন অস্ত্রের চালান। এছাড়া চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে দেশী প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র তৈরি করা হচ্ছে। খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ ছিনতাইয়ে অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র ছাড়াও বৈধ অস্ত্রধারীদের অস্ত্রও ভাড়ায় খাটছে। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিলেই ভাড়ায় মেলে পিস্তল-রিভলবার। অবৈধ অস্ত্রের গায়ের নম্বর টেম্পারিং (ঘষাঘষি) করে ‘নিখুঁতভাবে’ বৈধ অস্ত্রের নম্বর বসিয়ে ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ করছে একটি চক্র। আবার ৩০-৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলেও ক্ষুদ্রাস্ত্রের হোম সার্ভিস মিলছে। পুলিশের তালিকায় রাজধানীসহ সারাদেশে দুই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর তালিকা রয়েছে। তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামও। গোয়েন্দা মতে, অন্তত ৩০ পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সনদ্বীপ, সীতাকুন্ড, রাঙ্গুনিয়া, বান্দরবান, রাঙামাটির সাজেক, খাগড়াছড়ির রামগড় ও সুদারাম, ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, মংলা, উখিয়া, রামু, টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, রাউজান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, হিলি ও সিলেটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই অবৈধ অস্ত্র আসছে। দেশেও নিজস্ব পদ্ধতিতে অস্ত্র তৈরির কারখানা রয়েছে। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবসা থাকার অভিযোগ আছে। মেহেরপুরের গাংনীর সর্দারপাড়া ও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বিলগাথুয়া, জামালপুর, পাকুড়িয়া ভাঙ্গাপাড়া, মুন্সীগঞ্জ, চর মোহাম্মদপুর, চল্লিশপাড়া, ছলিমেরচর, গোড়েরচর, মরারচর, বাংলাবাজার দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র দেশে ঢুকছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা, বিনোদপুর, পোল্লাডাঙ্গা, বকচর, হাকিমপুর, বাখর আলী, বাগডাঙ্গা, মাসদুপুর, শিং নগর, মনোহরপুর, রঘুনাথপুর, কিরণগঞ্জ ও চৌকা এলাকার প্রায় ১০ কিমি. সীমান্ত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশের অন্যতম রুট। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, কুমিল্লার বিবিরবাজার, চৌদ্দগ্রাম, ফেনীর বিলোনিয়া, আমতলী, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ, বিরল, ফুলবাড়ী ও নওগাঁর ধামুইরহাটের সীমান্তবর্তী তিনটি গ্রাম দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ঢোকে। এসব ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীদের ধরতে শীঘ্রই অভিযান চালানোর পাশাপাশি সীমান্তে সতর্ক অবস্থা ও নজরদারি শুরু করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্র মতে, দেশের অপরাধ জগতের শীর্ষ সন্ত্রাসী ও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের হাতে আসা এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ খুবই বিপজ্জনক। এসব আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েই খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশে অস্থিতিশীল ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হতে পারে।
×