ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

শ্রদ্ধার প্রতিবিম্ব শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৭ অক্টোবর ২০১৮

শ্রদ্ধার প্রতিবিম্ব শেখ হাসিনা

উন্নয়নের রূপকার দেশরতœ শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বে উন্নয়ন রোল মডেলের পথিকৃতরূপে আবির্ভূত। ১৯৮১ সালে ১৭ মে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী অকুতোভয় সংগ্রামী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করে অবিনশ্বর কার্যক্রমের জন্য তিনি চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। আমরা অবগত আছি যে, বাংলার ঋতুরাণী শরত মাসে কাশফুলের শুভ্র-সৌম্য অপরূপ প্রকৃতি শোভিত ¯িœগ্ধ এক শুভলগ্নে শেখ হাসিনার জন্ম। ২০১৬ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর জনকণ্ঠ, সুপ্রভাত বাংলাদেশসহ কয়েকটি পত্রিকায় এই মহীয়সী নেত্রীর জন্মদিনে আমার নিবেদন ‘কাশফুল কন্যার জন্য প্রার্থনা’ প্রকাশ পেয়েছিল এবং এ জন্য বিপুল সংখ্যক আপামর জনগোষ্ঠীর প্রশংসা পেয়েছিলাম। প্রকৃত অর্থে নানাবিধ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যে শোভিত বাংলাবর্ষের শরৎবন্দনা বাঙালী সংস্কৃতিকে যুগে যুগে অপূর্ব দ্যোতনায় মহিমান্বিত করেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ শরতের নির্মল আকাশে সাদা মেঘের ছোটাছুটি দেখে রূপকল্পে লিখেছিলেন ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/আমি দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’ কবিগুরু আরও বলেছেন ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরির খেলা/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’ দ্রোহ, প্রেম ও প্রকৃতির কবি নজরুল বলেছেন ‘এল শারদশ্রী কাশ-কুসুম-বসনা/রসলোক বাসিনী লয়ে ভাদরের নদীসম রূপের ঢেউ/মৃদু মধুহাসিনী যেনো কৃশাঙ্গী তপতী তপস্যা শেষে/সুন্দর বর পেয়ে হাসে প্রেমাবেশে।’ ৪০ দশকের কল্লোলগোষ্ঠীখ্যাত আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় শরতের আকাশ, দুপুরভরা রৌদ্র, ফুল ও ফলের গুঞ্জরণসহ পাখিদের ভাবভাষাও বর্ণনা করেছেন। বাংলার কবিমানস শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘জেনেছি কাকে চাই কে এলে চোখ ফোটে/নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা।’ শরতের শিউলি চাদরে আচ্ছাদিত অন্ধকার রাত্রি শেষে আলোকিত সকাল, শস্যপূর্ণ মাঠ, কৃষাণ-কিষাণীর আনন্দের ফসলী গান ইত্যাদির সমন্বয়ে শরতের যে সাবলীল সত্য-সুন্দর-কল্যাণ-মঙ্গলের মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক বার্তায় প্রাণিত বাংলার মানুষ খুঁজে পায় দেশপ্রেমের নতুন ভাবনা এবং চেতনাসমৃদ্ধ উদ্ভাবনের অবগাহন। এই শরতে জন্ম নেয়া সামগ্রিক আলোকোজ্জ্বল নয়নাভিরাম রূপবৈচিত্র্যের অনন্য প্রভাবে দেশরতœ শেখ হাসিনার জন্ম এক অপরূপ দেশমাতৃকার প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং গণমানুষের কল্যাণ চিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। এ জন্যই তিনি বিশ্ব নন্দিত এবং যুগ পরিবর্তনের অসাধারণ আলোকবর্তিকা। আজ বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে উচ্চারণ করতে পারছে বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতিবিম্ব। এটি সর্বজনবিদিত যে, পাশ্চাত্যের তুলনায় প্রাচ্য তথা বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষে নারীনেত্রীর বিকাশ তেমন প্রাচীন কিছু নয়। মূলত পাশ্চাত্যের ১৭ শতকে উচ্চবিত্ত মহিলাদের গৃহস্থালি কর্মযজ্ঞ থেকে সামাজিক পরিম-ল অধিকমাত্রায় আকর্ষিত করে। ১৮ শতকের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণচাঞ্চল্য ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা নারী সমাজের অংশগ্রহণকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। সে সময় ইংল্যান্ড ও ইউরোপের মূল ভূ-খ-ের নারীরা শুধু সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, আধুনিক ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সম্পর্ক এবং তার চর্চা এক নতুন মাত্রিকতায় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডে এই মহিলা বুদ্ধিজীবীরা ‘ব্লুস্টকিংস বা জ্ঞানগরবিনী নারী’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। তারা সমসাময়িককালে বরেণ্য মণীষীদের বক্তব্য শুনে তা গ্রহণ-বর্জনের মতো চ্যালেঞ্জ প্রদান করে সমাজকে অনেক বেশি ঋদ্ধ করেছে। ১৭৮৯ সালে বিপ্লবী নারী পরিষদের পক্ষ থেকে ফরাসী পুরুষদের বিরুদ্ধে উচ্চারিত হলো ‘আপনারা অতীতের সব কুসংস্কার দূর করলেও, সবচেয়ে ব্যাপক ও প্রাচীনতম কুসংস্কারটিকে বহাল থাকতে দিয়েছেন। এর ফলে গোটা দেশের অর্ধেক মানুষ রাষ্ট্রীয় পদ, অবস্থান, সম্মান, ও সর্বোপরি আপনাদের মাঝে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।’ এই প্রেক্ষিতে নারীবাদীদের অন্যতম নেত্রী অলিমপি দ্য গোজ রচিত ‘ডিক্লারেমন অব রাইটস অব উইমেন এ্যান্ড সিটিজেনস’ গ্রন্থটি নতুন প্রণোদনায় নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অধিকারকে সমুন্নত করে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে বাংলার আকাশে বেগম রোকেয়াকেও ছাড়িয়ে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক গুণগত শিক্ষা দর্শন উপস্থাপন করে নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ, নারী ক্ষমতায়ন ও নারী নেতৃত্বের বিশ্বজয়ী আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ইতিহাসের অধ্যায়ে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে ১৮৫ পৃষ্ঠায় তাঁর অমিয় কিছু রচনা উদ্ধৃতি করার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। ‘আমি গোপালগঞ্জে আসলাম, মামলা চলছিল। সরকারী কর্মচারীরা সাক্ষী। সবাই প্রায় বদলি হয়ে গেছে। আসতে হয় দূর দূর থেকে, এক একজন এক একবার আসেন। আমি জেলে থেকে যাই আর সরকারী উকিল ও কোর্ট ইন্সপেক্টর ফরিদপুর থেকে আসেন। বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। বললাম কিছু ডিম কিনে দিতে, কারণ না খেয়ে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। এক মাসে শরীর আমার একদম ভেঙ্গে গিয়েছে। চোখের অবস্থা খারাপ। পেটের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। বুকে ব্যথা অনুভব করতে শুরু করেছি।’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু আমাকে সাবধান করল এবং বলল, ‘ভুলে যেও না, তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।’ ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কি করা যায়। ‘হাচু’ আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে। হাচু ‘আব্বা’ বলে দেখে কামালও ‘আব্বা’ বলতে শুরু করেছে। গোপালগঞ্জ থানা এলাকার মধ্যে থাকতে পারি বলে কয়েক ঘণ্টা ওদের সঙ্গে থাকতে সুযোগ পেতাম।’ এমন হৃদয়বিদারক, যন্ত্রণাকাতর ও চরম কষ্টদায়ক দেশের জন্য আত্মত্যাগে অভিনব উজ্জ্বলতায় ভাস্বর বিশ্বের মহানায়কদের শীর্ষে রয়েছেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালে ৩০ মে লিখেছিলেন ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ স্বাধীনতার পর পরই ১৯৭২ সালে এক জনসভায় তিনি বলেন ‘আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে-খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’ পিতার মতো সুযোগ্য তনয়াও অবিরাম ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে অপ্রতিরোধ্য গতিতে দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে গিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করছেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাবার মতো ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চান।’ এখানেই দেশপ্রেম, এখানেই সততা-সচ্চতা ও জবাবদিহিতা, এখানেই মানবিকতা-অসাম্প্রদায়িকতা-সৃজনশীলতা-অগ্রসরমানতা। এখানেই জাতির জনকের সোনার বাংলার পরিপূর্ণতা। লেখক : উপাচার্য, চটগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×