ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামের মানুষ তৈরি করছে উন্নয়নের রূপরেখা

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১ অক্টোবর ২০১৮

 গ্রামের মানুষ তৈরি করছে উন্নয়নের রূপরেখা

সমুদ্র হক ॥ মাঠপর্যায়ের উন্নয়ন এখন চোখে পড়ছে বহির্বিশ্বে। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশের উন্নয়ন নিচের ধাপ থেকে ওপরের দিকে যাচ্ছে। সাধারণের চাহিদার ভিত্তিতেই তৈরি হচ্ছে প্রতি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) উন্নয়নের রূপরেখা। যা বাস্তবায়ন করছে সরকারের লোকাল গবর্নেন্স সাপোর্ট প্রজেক্ট (এলজিএসপি)। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের শতভাগ সফলতায় এলজিএসপির তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যা শেষ হবে ২০২১ সালে। দেশের ৪ হাজার ৫শ’ ৫০টি ইউনিয়নের সঙ্গে এই প্রথমবার ৮ বিভাগ থেকে দুইটি করে ১৬ পৌরসভা যোগ হয়েছে এই কার্যক্রমে। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে এলজিএসপির তৃতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫ হাজার ৫শ’ ৩৫ কোটি টাকা। প্রতি পর্যায়ের মেয়াদ ৫ বছর। দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে এগিয়ে নিতে এলজিএসপি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এলজিএসপি কার্যক্রমে উন্নয়নের সমতার সঙ্গে মাঠপর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি ইউনিয়নের আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দ মেলে। প্রতিটি স্কিম গ্রহণ করা হয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ওয়ার্ড সভায় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠানো হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে। তারপর উপজেলা পরিষদের সভায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে প্রকল্প পাস করা হয়। প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজ বাস্তবায়নে নারীর সরাসরি ভ‚মিকা থাকে। প্রকল্পের ওয়ার্ড ভিত্তিক সব বৈঠকে নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। কর্মসূচীর কমিটিতে নারীর মতামত না থাকলে সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। এভাবে নারীর ক্ষমতায়নে এলজিএসপি বড় ভ‚মিকা রেখে এসডিজির ৫ম অধ্যায় পূরণে সহযোগী হয়েছে। মাঠপর্যায়ের প্রতিটি উন্নয়ন মনিটরিং ও অডিট করা হয় নিবিরভাবে। এ জন্য রয়েছে প্রজেক্ট ম্যানেজেমেন্ট ইউনিট। যার মাঠপর্যায়ে আছে প্রতি জেলার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক। তার সঙ্গে আছেন জেলা ফ্যাসলিটেটর (ডিএফ)। বগুড়ার জেলা ফ্যাসিলিটেটর (ডিএফ) মঞ্জুরুল হক জানান, তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোপূর্বের বগুড়া জেলার সাফল্য শতভাগ। ইউপির নানা কর্মসূচীর রাজস্ব সময় মতো জমা হয়েছে। বগুড়া এলজিএসপির বর্তমান দুইজন ডিএফ মঞ্জুরুল হক ও জুয়েল রানা এবং পূর্বতন ফ্যাসিলিটেটর রফিউন্নবীর নিজস্ব উদ্ভাবনে ইউনিয়ন পরিষদের মানুষের কর আদায়ে সেলফ এ্যাসেমেন্ট ফরম তৈরি হয়েছে। যা একত্রিত করে বাঁধাই করা হয়েছে। সাধারণের অংশগ্রহণ কর আদায়ের এই পন্থায় শতভাগ সাফল্য এসেছে। জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে। গেল অর্থবছরে বগুড়ার সেলফ এ্যাসেসমেন্টে সবচেয়ে বেশি কর আদায় হয়েছে আশেকপুর ইউপিতে। পরিমাণ প্রায় ১৪ লাখ টাকা। ডিএফ মঞ্জুরুল হক জানালেন, রুটিন কাজের বাইরে এই উদ্ভাবন সাড়া ফেলেছে। এলজিএসপির নির্দেশিকায় বলা আছে, ইউনিয়নে অডিট আপত্তি থাকবে সেই ইউনিয়নে বাৎসরিক বরাদ্দের ২৫ শতাংশ দেয়া হবে। আপত্তি নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাকি ৭৫ শতাংশ দেয়া হবে। সেভাবেই প্রতি ইউনিয়নে উন্নয়ন কাজে জবাবদিহি এসেছে। এ ছাড়াও প্রতি ইউনিয়নের ভাল কর্মকান্ডের ওপর ৪০ নম্বর বরাদ্দ করা আছে। যে ইউনিয়ন পারফর্মেন্সে ৪০ নম্বর পাবে তাদের উন্নয়নে বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হবে। বগুড়ার ১শ’ ৮টি ইউপির মধ্যে ৭৯ ইউপির পারফর্মেন্স ভাল। বাকিগুলো ভাল করছে। বগুড়ায় চলতি বছর ১শ’ ৮ ইউপিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৩ কোটি ৯৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫শ’ ৯৬ কোটি টাকা। বরাদ্দের অর্থ প্রতি ইউনিয়নের ব্যাংকের হিসাবে যোগ হয়েছে। প্রতি ইউনিয়নে বরাদ্দ মেলে জনসংখ্যা ও আয়তন ভেদে ২০ লাখ টাকা থেকে ৩৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। গেল বছর বগুড়ার ইউপিগুলোতে ২ হাজার ৫টি স্কিম বাস্তবায়িত হয়েছে। এলজিএসপির অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় উন্নয়ন কর্মকান্ড দেখে। প্রথমে দেয়া হয় মৌলিক থোক বরাদ্দ (বিবিজি)। এই অর্থে সফল উন্নয়ন দেখাতে পারলে পরবর্তী সময়ে আরেকটি বরাদ্দ মেলে যা দক্ষতা ভিত্তিক বরাদ্দ (পিবিজি)। আশা করা হয়েছে আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে পিবিজির বরাদ্দেও বগুড়া এগিয়ে থাকবে। একটা সময় যে গ্রামের প্রসূতি রাস্তা এবড়ো থেবড়ো থাকায় হাসপাতালে পৌঁছতে পারত না তারা এখন সময়মতো ম্যাটারনিটি সেন্টারে পৌঁছে। সুস্থ শিশুর জন্ম দেয়। মা ও শিশু নিরাপদে থাকে। এলজিএসপি এভাবে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে কয়েকটি অধ্যায়ে সহযোগী হয়েছে। গ্রামে পল্লী বিদ্যুত না গেলে সোলার প্যানেলে বিদ্যুতায়িত হয় প্রতিটি ঘর। গ্রামের কোথায় কি করতে হবে তার চাহিদার নিরূপণ করে ওয়ার্ডের লোকজন। তারপর ইউপিকে জানায়। ইউপি ওয়ার্ডের ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয় ও জবাবদিহি করে। পরিষদ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোটখাটো অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করে। কোন স্কিম বাস্তবায়িত করার আগে পুরুষ ও নারীর সমন্বয়ে দেখভাল (সুপারভাইজার) কমিটি গঠিত হয়। সবার কাজেই থাকে জবাবদিহি। এলজিএসপি প্রথম পাইলট প্রকল্প করে সিরাজগঞ্জ। ২০০৬ সালে প্রথম পর্যায়ের এলজিএসপি শুরুর পর পাঁচ বছরের সফলতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। বর্তমানে তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে গেল বছর। ওই বছর ৩১ জানুয়ারি একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলজিএসপির অর্থ বরাদ্দ দেন। সফলতার ওপর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, এমনটি জানিয়েছে সূত্র। এভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের (২০৩০ সাল) আগে এসডিজি অর্জনেও সক্ষম হবে। বগুড়ার গোকুল ইউপি চেয়ারম্যান সওকাতুল ইসলাম বলেন, এলজিএসপির বরাদ্দ যেভাবে এবং যে জবাবদিহির মধ্যে আসে তাতে গ্রামের নারী পুরুষের সরাসরি অংশগ্রহণে উন্নয়নের গতি বাড়ে। সকলের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে। গেল বছর তিনি যে অর্থ পেয়েছেন দ্রুত উন্নয়ন কাজ করার পর সাফল্যের ভিত্তিতে দক্ষতা ভিত্তিক বরাদ্দ পেয়েছেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই ইউপিতে বিবিজির বরাদ্দ মিলেছে ১৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭শ’ ৪৭ টাকা। পিবিজির বরাদ্দ মিলেছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। বগুড়ার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক সুফিয়া নাজিম জানালেন, এলজিএসপির কাজে সফলতা এসেছে। এই কাজের বৈশিষ্ট্য হলো- দেখভাল ও গ্রামের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিও থাকেন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সর্বনিম্ন ধাপ ইউনিয়ন পরিষদকে আগে যেভাবে মূল্যায়ন করা হতো এখন তা পাল্টেছে।
×