ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

যাহিদ হোসেন

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১ অক্টোবর ২০১৮

 মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

(গতকালের পর) ব্যক্তিগতভাবে আমি যেহেতু আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে নিয়মিত সাপ্তাহিক ‘জবাব দাও’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পূর্বেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দূকে বাঙালীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ ‘এবং আরও কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সময়কালে কলকাতা কেন্দ্রের আঞ্চলিক প্রধানের সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপিত হলে তিনি আমাদের অনুরোধক্রমে রেডিও পাকিস্তান থেকে প্রচারিত এই প্রচারণামূলক অনুষ্ঠানসমূহের একটা সারসংক্ষেপ আমাকে প্রতি সপ্তাহেই সরবরাহ করা হতো আকাশবাণী থেকে যেটা আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার কাজে ছিল খুবই সহায়ক। উইং কমান্ডার এমকে বাশার উইং কমান্ডার এমকে বাশার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন জিডিপি অফিসার হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে স্থলযুদ্ধে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিক এবং স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেসামরিক যোদ্ধাদের নিয়ে আমাদের ১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে যে নৈপুণ্য পারদর্শিতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন সেটা ইতিহাসে একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত হবে। মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর স্টাফ প্রধান হয়েছিলেন এবং বিমান বাহিনীর একটা প্রশিক্ষণ কোর্স উদ্বোধন শেষে নিজে ওই বিমানটি পরিচালনা করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সেই অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল পরিচালক আইএসপিআর হিসেবে। আমাদের সঙ্গে আলোচনার শুরুতেই তিনি নিজেকে সেক্টর কমান্ডারের চেয়ে একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক গর্ববোধ করার কথা বললেন। তবে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনায় যে দুটো বিষয়ে গুরুত্বসহকারে সব সময়ই দেশের ভেতরে অবস্থানরত আমাদের জনগণ এবং বিশ্ববাসীর কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার কথা বললেন সেটা হলো যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আমরা বাঙালীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্তে¡ও দারুণভাবে বৈষম্যের স্বীকার হয়েছি। তা সত্তে¡ও আমরা কিন্তু সব সময়ই আমাদের দাবি আদায়ের জন্য সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক উপায় বেছে নিয়েছি। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের প্রথম একটি সার্বজনীন নির্বাচনে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সংসদ ডাকার আহবান জানিয়েছি এবং প্রয়োজন হলে আলোচনার আহবানও জানিয়েছি এবং আলোচনায় বসেছিও। কিন্তু তারা সে পথে আসেনি। অতর্কিতে রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র, নিরপরাধ বাঙালীর ওপর আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রয় করা সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও কামান, বন্দুক নিয়ে। আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করতে। কিন্তু ওরা অর্থাৎ পাকিস্তানীরা যুদ্ধ চাপিয়ে দিল আমাদের ওপর। আমরা তো যুদ্ধ চাইনি। তাই বিশ্ব জনমত আমাদের পক্ষে। শুধুমাত্র তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন, চীন ও সৌদি আরবসহ কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ছাড়া সারা বিশ্ব আমাদের পক্ষে। এমনকি মার্কিন জনগণ এবং গণমাধ্যমও আমাদের পক্ষে সোচ্চার। আমেরিকার সব বড় বড় শহরে আন্দোলন হচ্ছে আমাদের স্বপক্ষে যদিও তৎকালীন সরকার ছিল আমাদের বিপক্ষে। উইং কমান্ডার বাশার আমাদের জানালেন যে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, উপরোক্ত দুটো বিষয় যথাযোগ্যভাবে বিশ্ববাসীর কাছে গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রচার ও প্রকাশ করা সম্ভব হলে- বিশ্ব জনমত আরও বেশি কার্যকরীভাবে আমাদের পক্ষে সক্রিয় হবে এবং নিশ্চিতভাবে আমাদের বিজয় হবে আরও ত্বরান্বিত। ॥ অষ্টম পর্ব ॥ মেজর এমএ মঞ্জুর আমরা যখন মেজর মঞ্জুরের সঙ্গে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে আলাপ করার জন্য যাই তখন তিনি খুবই ব্যস্ত ছিলেন। তিনি মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তিনি আমাদের তার অফিসে স্বাগত জানিয়ে প্রথমেই জানতে চাইলেন আমরা কখন থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এই কাজটি শুরু করেছি এবং কি ধরনের কাজ এতদিন করে আসছি। যেহেতু মেজর মঞ্জুর একজন শিক্ষিত, জ্ঞানী এবং উচ্চমানের অফিসার হিসেবে অনেকের তরফ আমাদের ধারণা দেয়া হয়েছে। তাই আমরাও মোটামুটিভাবে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছি তার অফিসে। তিনি আমাদের তার অপারেশন কক্ষে নিয়ে গেলেন এবং প্রথমেই একটা ম্যাপ দিয়ে তার সেক্টরের ভৌগোলিক অবস্থান তার সেক্টরে অবস্থিত পাক সেনাবাহিনী স্থাপনাসমূহ এবং কোথায় কোথায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে ওই সময়ে অপারেশন পরিচালনা করছেন সেটা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করলেন। তিনি খোলাখুলিভাবে আমাদের জানালেন যে যেহেতু তিনি মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন তাই তখনও তিনি বিস্তারিতভাবে জানার চেষ্টা করছেন যে তার সেক্টরে শত্রæদের অবস্থান কতটা শক্তিশালী এবং তারা তার এলাকায় কিভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। মেজর মঞ্জুর আমাদের জানালেন যে সেক্টরে বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই একটা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবেন যা তখনও তিনি চ‚ড়ান্ত করতে পারেননি। তবে আমাদের জন্য তিনি তার নিজ হাতে লেখা একটা সুপারিশমালা আমাদের দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের জানালেন যে ২৬ মার্চ থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যত দিন পাকিস্তানে অবস্থান করছিলেন তখন পাকিস্তানে বসে মুক্তিযোদ্ধারা এতটা কার্যকরীভাবে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের প্রতিহত করে যাচ্ছে দিনের পর দিন এতসব খবরাখবর তেমনভাবে তারা পাননি কখনও। তাই মেজর মঞ্জুর আমাদের প্রথমেই যে কাজটি করে যাওয়ার জন্য চিন্তাভাবনা করে সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে একটা কর্মপন্থা প্রণয়ন করার কথা বললেন সেটা হলো মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি এবং ক‚টনীতিক কর্মকান্ডও এবং সেক্টরে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত অভিযানে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা কিভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে দিনের পর দিন সেটা প্রতিফলিত করে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করে কিভাবে সারা বিশ্বে বিশেষ করে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচার করা যায় সে বিষয়ে গুরুত্বসহকারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাতে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা সাধারণ জনগণ এবং গণমাধ্যম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা পেতে পারে। মেজর মঞ্জুর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে আমাদের চারটি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে আমাদেরকে ভবিষ্যত কর্মপ্রণালী প্রণয়ন করার পরামর্শ দিলেন। আর এ চারটি বিষয় হলো (ক) পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা ও জনগণের মন ও মানসিকতা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞতা (খ) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের রাজনৈতিক এবং সাধারণ সহযোগীদের মন মানসিকতা, (গ) সাধারণভাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় করা এবং (ঘ) আমাদের সপক্ষে বিশ্বমত সৃষ্টি করবো। মেজর সিআর দত্ত সেক্টর কমান্ডার মেজর সিআর দত্তের সঙ্গে যখন আমাদের আলোচনা হয় তখন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের একটা প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করছিলেন। তিনি বসলেন একটা টুলে এবং আমাদের অর্থাৎ আমাকে আর সহকর্মী সাংবাদিক আল মুজাহিদিকে বসতে দিলেন একটা বেঞ্চে। প্রায় এক শ’ জন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তিনি এবং তার আরও দু’জন সহকর্মী। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে মনে হলো তাদের অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসা ২০/২৫ বছরের যুবক। আলোচনার শুরুতেই মেজর দত্ত তার সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত বিগত কয়েকদিনের কয়েকটি অভিযানের সাফল্য ও ব্যর্থতার একটা বিবরণী আমাদের দিলেন। তিনি আমাদের জানালেন যে তিনি আশাবাদী যে নবেম্বর মাসের মধ্যে তার সেক্টরের অধিকাংশ এলাকা তারা শত্রু মুক্ত করে মুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করতে সক্ষম হবেন। তার ধারণা আমরা যত বেশি এলাকা শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হব, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে ক্রমে ক্রমে তত বেশি এবং রাজাকারদের অনেকেই হানাদার পাক বাহিনীর পক্ষ পরিত্যাগ করে যোগ দেবে আমাদের সঙ্গে। ফলে হানাদার পাকবাহিনীর সদস্যরা ভীত হয়ে নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য থানা এলাকা পরিত্যাগ করে পালিয়ে যাবে প্রধান প্রধান শহরে অবস্থিত তাদের সেনানিবাসগুলোতে আশ্রয় গ্রহণের জন্য। আর এই সমস্ত খবরাখবর যদি আমরা যথাযোগ্যভাবে আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী বিবিসি এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের। সহযোগিতায় ব্যাপকভাবে প্রচার করতে সমর্থ হই তাহলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা আরও বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হবে ভবিষ্যতে আরও বেশি সাহসিকতা ও বীরত্বের সঙ্গে তাদের অভিযান পরিচালনায়, ফলে দেশের মানুষের মনোবলও বেড়ে যাবে বহু গুণে এবং বিশ্ব জনমত ও আরও কার্যকরীভাবে আমাদের সপক্ষে ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবে। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×