ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে বার বার অঘটন- অদক্ষতা, না সুপরিকল্পিত?

প্রকাশিত: ০৫:০২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে বার বার অঘটন- অদক্ষতা, না সুপরিকল্পিত?

আজাদ সুলায়মান ॥ প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের দায়িত্ব নিয়ে বার বার অবহেলা ও গাফিলতির ঘটনা ঘটছে। একের পর এক অঘটন ঘটলেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না দায়ীদের বিরুদ্ধে। আমলে নেয়া হচ্ছে না গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিদের্শনাও। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছারও প্রতিফলন ঘটছে না। উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটি, ভুলবশত অনাকাক্সিক্ষত বস্তু ওঠানো, মদ্যপ অবস্থায় ক্রু ওঠার চেষ্টা, বিতর্কিত ব্যক্তিদের ফ্লাইট অপারেট করার মতো ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে- গত তিন বছরে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা কি সুপরিকল্পিত, নাকি স্রেফ কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও অবহেলার প্রতিফলন। এ নিয়ে খোদ বিমানের ভেতরেই চলছে সমালোচনা, গুঞ্জন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে লন্ডনগামী প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে ওঠার সময় এক মদ্যপ কেবিন ক্রুর ধরা পড়া ও এ ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য শুধু একজনকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে বাকিদের রক্ষার কৌশলে গোয়েন্দারাই অবাক। ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দারা এমন কিছু তথ্য পেয়েছেন যা বিস্ময়কর। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে, শুক্রবার সকাল দশটায় প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট টেক অফের তিন ঘণ্টা আগে ব্রিফিং রুমে কেবিনক্রুদের ডেকে নিয়ে হঠাৎ ডোপ টেস্ট শুরু করে। ডাইরেক্টর ফ্লাইট অপারেশন (ডিএফও) ক্যাপ্টেন ফারাহাত জামিলের উপস্থিতিতে ডোপ টেস্ট করেন বিমানের নিজস্ব চীফ অব মেডিক্যাল (সিএমও) ডাক্তার তসলিমা। ১৮ কেবিন ক্রুর মধ্যে একমাত্র মাসুদা মুফতির শরীরে পজিটিভ মেলে। সঙ্গতকারণেই বিমানের রুলস মেনে তাকে অফলোড করা হয়। এরপর এক কেবিন ক্রু কম নিয়েই অর্থাৎ ১৭ জন নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট অপারেট হয়, যার পাইলট ইন চীফ ছিলেন ক্যাপ্টেন ফারাহাত জামিল। তিনি এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্দেশনা না দিয়েই সরাসরি উঠে যান ককপিটে। সেখান থেকে তিনি বিমানের এক জিএমকে ফোন করে অনেকক্ষণ কথা বলেন এবং ককপিটে গিয়ে তাকে চা পানে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তখনও তিনি ওই জিমএমকে বিষয়টি অবহিত করেননি। গোয়েন্দারা অবাক এ জন্যই ক্যাপ্টেন ফারাহাত এ ঘটনা গ্রাহক সার্ভিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে বলেননি। এমনকি ককপিটের লগবুকেও তা উল্লেখ করেননি। ওই ফ্লাইটের দায়িত্ব পালনকারী এক কর্মকর্তা জানান, তিনি যদি জিএমকে বিষয়টি অবহিত করতেন- তাহলে শনিবার মাসুদা মুফতিকে সিঙ্গাপুর ফ্লাইটে ডিউটি থেকে বিরত রাখা সম্ভব হতো। সেটা না করে পুরো ঘটনা সবাই যখন ধামাচাপার চেষ্টা চালায় তখনই তা এক কর্মকর্তা ফাঁস করলে হুলস্থূল পড়ে যায়। এরপর পরিস্থিতি সামাল দিতে মুফতিকে গ্রাউন্ডেড এবং নুরুজ্জামান রঞ্জুকে ডিজিএমের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আর কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা বা কারণ দর্শানোও হয়নি। মূলত রঞ্জুকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়ে অন্যদের ব্যর্থতা ও দোষত্রুটি ঢাকার কৌশল গ্রহণ করে বিমান ম্যানেজমেন্ট। ঘটনা তদন্তকারী এক গোয়েন্দা বিস্ময় প্রকাশ করে বিমানের কাছে জানতে চান, এর আগে কেন ডোপ টেস্ট করা হয়নি বিমানে? প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট দিয়ে কেন সেটা চালু করে বিতর্কের সৃষ্টি করা হলো? আগে থেকেই যদি ডোপ টেস্টে বিধান চালু করা হতো, তাহলে কেউ মদ খেয়ে এই ফ্লাইটে ওঠার সাহস দেখানো দূরের কথা কল্পনাও করত না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ডোপ টেস্টের সিদ্ধান্তের সময় স্ট্যান্ডবাই কেবিন ক্রু না রাখাটাও ছিল আপত্তিকর। যদি সে প্রস্তুতি থাকত তাহলে একজন ক্রু কম নিয়ে যেতে হতো না। প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট নিয়ে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার এখানেই শেষ নয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর ড্রিমলাইনার উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ফ্লাইট দিয়ে লন্ডন যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার সে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভিভিআইপি ফ্লাইটের কো-অর্ডিনেশন মিটিংয়ে এ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তখন বিমান থেকে বলা হয়, বোয়িং ৭৭৭-এর যাত্রী পূর্ণ হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে ড্রিমলাইনার দেয়া হলে কিছু যাত্রীকে অফলোড করতে হবে। আসলে এটা ছিল বিমানের স্রেফ মিথ্যাচার। প্রকৃত কারণ হলো- বিমান এখনও পর্যন্ত ওই ড্রিমলাইনের ডকুমেন্টেশন তৈরি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। তাই এমন একটা মিথ্যাচার করে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। এ বিষয়ে বিমানের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০ সেপ্টেম্বর ড্রিমলাইনার আসবে সেটা নির্ধারণ করা হয়েছিল তিন বছর আগে। এতদিনেও বিমান এই ড্রিমলাইনটি দিয়ে লন্ডন ফ্লাইটের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারেনি। এটা বিমানের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতা নাকি অন্যকিছু সেটাই বড় প্রশ্ন। বিমান সূত্র জানিয়েছে, এর আগে যখন বোয়িং ৭৭৭ ও ড্যাশ-৮ আনা হলো- তখন কিন্তু একদিনের জন্যও ফ্লাইট বসিয়ে রাখা হয়নি। সব প্রস্তুতি অনেক আগেই নেয়া হয়েছিল। এবার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা প্রকাশের তিন সপ্তাহের মধ্যে বিমান এ প্রস্তুতি নিতে না পারাটা ছিল ক্ষমার অযোগ্য ব্যর্থতা। এবারের লন্ডন ফ্লাইটের আগেও একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট নিয়ে অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার পরও বিমানের টনক নড়েনি। বছর দুয়েক আগে বুদাপেস্ট যাওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়ায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় হয়। সে ঘটনায় শুধু কজন প্রকৌশলীকে গ্রেফতার করা ছাড়া উর্ধতন কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেদিনের ফ্লাইটেও ক্যাপ্টেন ফারাহাত জামিলসহ কজন বির্তকিত ক্রু ডিউটি করার বিষয় নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে এসএসএফের অনুমোদনবিহীন একটি ফ্লাক্স ওঠানোর ঘটনায় তোলপাড় হয়। এর কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রীর অপর একটি ফ্লাইটে ব্যবহারিক জিনিসপত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিমানের জন্য মানসম্মত কম্বল, টিস্যু, কুশন, কার্পেট, পর্দা ও অন্যান্য জিনিস নিশ্চিত করে তা এসওপি-ভুক্তির নির্দেশ দেয়া হয়। বিমান থেকে এ সংক্রান্ত্র একটি ফাইলও অনুমোদনের জন্য দেয়া হয়। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট তা প্রত্যাখ্যান করে উল্টো ফাইল ইনিশিয়েট করার অপরাধে এক জিএমকে সরিয়ে দেয়। এ সম্পর্কে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে বার বার এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে আর ম্যানেজমেন্ট তা মেনে নিচ্ছে কিভাবে? শর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে তাহলে তো এমনটি আরও ঘটবে।
×