ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সিনেটর জন সিডনি ম্যাককেইন ॥ দৃঢ়চেতা এক রাজনীতিবিদ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সিনেটর জন সিডনি ম্যাককেইন ॥ দৃঢ়চেতা এক রাজনীতিবিদ

২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সে দেশের ডেমোক্র্যাট দলের মনোনীত প্রার্থী আফ্রো-আমেরিকান বারাক ওবামার বিপক্ষে লড়েছিলেন রিপাবলিকান দলের জন ম্যাককেইন (তৃতীয়)। ম্যাককেইনের এক নির্বাচনী র‌্যালিতে রিপাবলিকানদের সমর্থকরা যখন কৃষ্ণ ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক ধ্বনি দিচ্ছিলেন তখন এক খ্রীস্টান মহিলা আরব দেশে নারীদের অধিকার তার বিবেচনায় খর্ব থাকায় চিৎকার করে বলেছিলেন তিনি ওবামাকে বিশ্বাস করেন না, কেননা তিনি আরব বংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছেন। প্রত্যুত্তরে ম্যাককেইন পরম সৌজন্যবোধ নিয়ে বলেছিলেন না, মহোদয়া, এ সত্যি নয়; ওবামা একজন পরিচ্ছন্ন পারিবারিক মানুষ এবং একজন নাগরিক যার সঙ্গে কতিপয় মৌলিক বিষয়ে তার কেবল মতপার্থক্য রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে স্বপক্ষীয়দের বিরোধিতা সত্ত্বে¡ও ম্যাককেইনের ওই কথা আমাকে তার উঁচু পর্যায়ের সৌজন্য ও নীতিবোধের জন্য অভিভূত করেছিল। তখন থেকে আমি সিনেটর ম্যাককেইনের জীবন ও কর্ম বিষয়ে জানতে চেয়েছি। জন সিডনি ম্যাককেইনের জন্ম ১৯৩৬-এর ২৯ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্র শাসিত পানামা খালের পাড়ে অবস্থিত কোকো সালো নৌবাহিনীর বিমান স্টেশনে। তার বাবা ম্যাককেইন (দ্বিতীয়) ছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীর নামজাদা অফিসার। চার তারকা এডমিরাল হয়েছিলেন শেষ জীবনে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সকল বাহিনীর সর্বাধিনায়কের ভূমিকায়। এর আগে তার দাদা ম্যাককেইন সিনিয়রও নৌবাহিনীর এডমিরাল হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে জাপানের আত্মসমর্পণের সাক্ষী হিসেবে আমেরিকার নৌবাহিনীর পরাক্রমের প্রতিভূ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। পরে নৌবাহিনীর দুটি ডেস্ট্রয়ার ম্যাককেইন সিনিয়র ও ম্যাককেইনের (দ্বিতীয়) নামে তাদের সম্মানিত করে নামায়িত হয়েছিল। মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপন করে ম্যাককেইন তার দাদা ও বাবার পথ ধরে আনাপলিসে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নৌবাহিনী একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে একাডেমির শিক্ষা শেষে তিনি নৌবাহিনীর বিমান পক্ষে যোগ দিয়ে ক্রমান্তরে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ইন্ট্রিপিড ও এন্টারপ্রাইজে কিউবা সঙ্কটের সময়ে (১৯৬২) নৌ বৈমানিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বিধবা মডেল কন্যা কেরল শেপকে পরিবারের অন্যান্যের মত এড়িয়ে গোপনে মেক্সিকোতে গিয়ে বিয়ে করে কেরলের আগের ঘরের ২ সন্তানকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। কেরলের সঙ্গে বিয়ের পর তাদের একজন মেয়ে সিডনি জন্ম নেয়। এরপর তার নিজের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তারই দোষের জন্য কেরলের সঙ্গে তার বিবাহিত সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৯৮০ সালে কেরলের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি শিক্ষিকা সিনডি হেনসলিকে বিয়ে করেন। এই বিয়ের বাঁধনে তাদের ২ পুত্র সন্তান জন্মানোর পর ঢাকায় মাদার তেরেসার এতিমখানা থেকে সিনডি বাংলাদেশের এক পরিত্যক্ত ও রুগ্ন মেয়ে শিশুকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান এবং তাকে তারা দত্তক সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। সে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমঅধিকারসম্পন্ন সন্তান হিসেবে এই অনাথ মেয়েকে গ্রহণ করে তারা তাকে নাম দেন ব্রিজিট। ১৯৬৭ সালে ম্যাককেইন বিমানবাহী জাহাজ ফরেস্টালে বৈমানিক হিসেবে যোগ দিয়ে তখনকার সামনের সারির যুদ্ধবিমান স্কাইহকের চালক হিসেবে উত্তর ভিয়েতনামে বোমা বর্ষণের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এই সময় ১৯৬৭-এর ২৯ জুলাই তিনি যুদ্ধজাহাজ ফরেস্টলে এক অগ্নিদুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হন। এই দুর্ঘটনায় ফরেস্টালের ১৩৪ জন নাবিক ও বৈমানিক নিহত হন। তথাপিও এরপরে ম্যাককেইন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ওরিসকানিতে স্বেচ্ছায় যোগ দেন। সে জাহাজ থেকে তিনি ১৯৬৭-এর ২৬ অক্টোবর তার জীবনের ২৩তম বিমান অভিযানে উত্তর ভিয়েতনামের হ্যানয়ে বোমা ফেলার পর ফিরে আসার সময় সোভিয়েত নির্মিত ভূমি থেকে আকাশ ধাওয়া মিসাইলের আঘাতে নিকটস্থ তুরক বাচ হ্রদে পতিত হয়ে আহত অবস্থায় সে দেশী মুক্তি সংগ্রামীদের হাতে বন্দী হন। প্রায় সাড়ে ৫ বছর ১৯৭৩-এর ১৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি ভিয়েতনামীদের হাতে হ্যানয়ের কুখ্যাত হো লো জেলে বন্দী জীবনযাপন করেন। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে তার ওপর নির্মম অত্যাচার করা হয়, নির্জন বাস আরোপ করে তাকে সঙ্কল্পবোধ থেকে বিচ্যুত করার অপচেষ্টা করা হয়। তার ভাঙ্গা হাতপার ওপর নিয়ম করে বারবার আঘাত করা হয়। কিন্তু তিনি তার দৃঢ় সঙ্কল্পে গভীর সম্মানবোধকে আশ্রয় করে অনড় থাকেন। তিনি যুদ্ধকালীন আঘাত ও বন্দী জীবনের অত্যাচারের ফলে পরবর্তী জীবনে তার মাথার ওপর হাত তুলতে পারতেন না, তার চুল অন্যকে আঁচড়িয়ে দিতে হতো। ১৯৬৮-এর জুলাই-এ তার পিতা ম্যাককেইন (দ্বিতীয়) যখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সকল মার্কিন সেনার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন ভিয়েতনামীরা যুদ্ধের প্রায় শেষ প্রান্তে ম্যাককেইনকে অন্য যুদ্ধবন্দীদের আগে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন। অবশ্য বন্দী জীবনের শেষ প্রান্তে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে তিনি ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে গুপ্তচর হিসেবে অপপ্রচারমূলক দোষ স্বীকার মর্মী একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। ১৯৭৩-এর ১৪ মার্চ প্যারিস শান্তি চুক্তি অনুযায়ী ভিয়েতনামে যুদ্ধের অবসান ঘটলে এবং মুক্তি সংগ্রামে জয়ী হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীভূত হলে ম্যাককেইন আহত বীরের সম্মান নিয়ে ৩৬ বছর বয়সে স্বদেশের অঙ্গরাজ্য এরিজোনায় ফিরে যান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কোন পক্ষকে তিনি সমর্থন দিতে অপারগ ছিলেন। বলা চলে মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তিনি পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে বাংলাদেশের প্রতিকূলে কোনদিনই সমর্থন দিতেন না। ১৯৮১ সালের ১ এপ্রিল তিনি নৌবাহিনী থেকে ক্যাপটেন হিসেবে অবসর গ্রহণ করে তার মা রবার্টার উৎসাহে রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে ম্যাককেইন এরিজোনা অঙ্গরাজ্য থেকে মার্কিন প্রতিনিধি সভার সদস্য হিসেবে রিপাবলিকান দলের পতাকার আওতায় নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে একই পদে তিনি পুনর্নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি এরিজোনা অঙ্গরাজ্যের তৎকালীন রক্ষণশীলতার পুরোধা ব্যারি গোল্ড ওয়েটারের অবসর গ্রহণ করার পর তার স্থলে সিনেটর নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, এই ব্যারি গোল্ড ওয়াটার ম্যাককেইন ভিয়েতনামে বন্দী থাকাকালীন সেখানকার মুক্তিযুদ্ধ দমন করার লক্ষ্যে পারমাণবিক হস্তক্ষেপের প্রস্তাব করেছিলেন। সিনেটর হিসেবে ক্রমান্তরে তিনি সশস্ত্র বাহিনী ও বাণিজ্য বিষয়ক কমিটিতে সদস্যপদ লাভ করেন। এর পরে লিঙ্কন সঞ্চয় ও ঋণ সমিতির দেউলিয়াত্ব বিষয়ে আরও ৪ সিনেটরসহ তদ্বিরকারী হিসেবে জড়িত হয়ে তিনি সিনেট কর্তৃক তিরস্কৃত হন। পরের বছরগুলোতে ম্যাককেইন সিনেটে বিশেষ স্বার্থের প্রতিবাদকারী, ন্যায়নীতি বিশেষত নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অর্থায়নের ক্ষেত্রে আপোসহীন সংগ্রামী হিসেবে পরিচিতি পান। তিনি ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের শাসনামলে সোমালিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও বলকান এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি প্রযুক্তকরণের প্রতিকূলে এবং কসোভোর স্বাধীনতা অর্জনের বিপরীতে তথা রাশিয়ার অনুকূলে অবস্থান নেন এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কার্যক্রমের বিষয়ে জাতির শ্রুতিতে সাবধান বাণী তুলে ধরেন। ১৯৯৩ সালে তিনি বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রসারের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সিনেটর হিসেবে তিনি ভিয়েতনামে তার সহযোদ্ধা ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর জন কেরির সঙ্গে একযোগে কাজ করে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভিয়েতনামকে পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদানে কার্যকর ভূমিকা রেখে এককালের পরম শত্রু দেশকে মিত্র দেশের পর্যায়ে উঠিয়ে আনার প্রশংসনীয় নীতিভিত্তিক পদক্ষেপ নেন। ১৯৮৩ সালে তিনি মানুষের সমঅধিকার জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠার মহানায়ক মার্টিন লুথার কিংয়ের স্মরণার্থে দিবস নির্ধারণের বিরোধিতা করেন। পরে এরূপ বিরোধিতা ভুল বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি সিনেটের ক্ষমতাধর বাণিজ্য কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো সিনেটর নির্বাচিত হন। ৫মবার সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার পর ডেমোক্র্যাটিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতাধর সশস্ত্র সার্ভিস কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে তিনি জর্জ বুশের সঙ্গে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্টের পদে মনোনয়ন প্রার্থী হয়ে হেরে যান। বুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ২০০১-এর সেপ্টেম্বর ১১-এ নিউইয়র্কে আল কায়েদা গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী অভিযানের পর তিনি সর্বাত্মক দৃঢ়তার সঙ্গে বুশ প্রশাসনের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমকে সমর্থন করেন, আফগানিস্তানের তালেবান বিদ্রোহীদের প্রতিকূলে অবস্থান নেন, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে ন্যায়নিষ্ঠ বলে তুলে ধরেন। তার চেষ্টায় ২০০২ সালে ম্যাককেইন-ফিনগোল্ড আইনের আওতায় নির্বাচনে অর্থায়ন সীমিত ও তত্ত্বাবধায়নকরণের বাধ্যকতা গৃহীত হয়। ২০০৫ সালে তার প্রস্তাব ও প্রচেষ্টা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সকল যুদ্ধবন্দী, এমনকি গুয়ানতামো উপসাগরের তীরে অবস্থিত অন্তরীণাধীন দৃশ্যত যুদ্ধাপরাধীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার বন্ধ করণের আইন অনুমোদিত হয়। পরে ২০০৮-এ রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তিনি ডেমোক্র্যাট দলের বারাক ওবামার কাছে পরাজিত হন এবং পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও আজীবন ২০১৮-এর ২৫ আগস্টে নিরারোগ্য ক্যান্সারে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিনেটর হিসেবে রাজনৈতিক দল নয়, স্বীয় বিবেকের অনুশাসন অনুযায়ী সম্মানিত রাজনীতিবিদের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি তার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে আলাস্কার মহিলা গবর্নর সারা পলিনকে মনোনীত করে সারার অনুকূলে সমর্থনের দুর্বলতা সত্ত্বেও নারীর সমঅধিকার ও সক্ষমতার অনুকূলে তার প্রত্যয় তুলে ধরেছিলেন। সিনেটর হিসেবে তিনি ওবামার চিকিৎসা বিষয়ক বীমা ব্যবস্থার বা ওবামা কেয়ারের বিরোধিতা করেছেন। আবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুযায়ী ওবামা কেয়ার বিষয়ক আইনটিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে বাতিল করার প্রস্তাব সিনেটে প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ জনগণের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন। এই কাজে তিনি আধুনিক যুগের পথ দেখানো বাতিঘরের দায়িত্ব পালন করেছেন বলে স্বীকৃতি পান। তিনি সারা জীবনে ছয়টি বই লিখেছিলেন। তার মধ্যে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘আমার পিতাদের বিশ্বাস’ জাতীয়ভাবে ‘সর্বোত্তম বিক্রীত বই’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। তার মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস তাকে ‘সুখী যোদ্ধা’ হিসেবে অভিহিত করেছে (দ্রষ্টব্য : নিউইয়র্ক টাইমস, আগস্ট ২৭, ২০১৮ মুক্ত সম্পাদকীয়)। আগেই বলেছি, সিনেটর ম্যাককেইনের জীবন ও কর্ম বিষয়ে আমি প্রথম আকৃষ্ট হই বারাক ওবামার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের সময় তার প্রকাশ্য সৌজন্যবোধ ও অকৃত্রিম সততায় উজ্জ্বলিত উক্তি- ওবামা আরবদের মতো নারীকে মুক্ত ও সাবলীল জীবন থেকে দূরে রাখেন না- তিনি একজন পরিচ্ছন্ন পারিবারিক মানুষ উপলব্ধি করেন। পরে তার জীবনধারা পর্যালোচনা করে আমি দেখেছি ভিয়েতনামে বন্দী অবস্থায় তার ওপর নির্মম অত্যাচার আরোপণ সত্ত্বেও তিনি তার শত্রুদের কাছে নতি স্বীকার করেননি, পিতার পদবি ও প্রভাবের সুযোগ নিয়ে অন্য বন্দীদের পেছনে ফেলে নিজের মুক্তি বেছে নেননি। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি তিনি সন্ত্রাস দমনের পরম বিরোধিতা বিবেকে ধারণ করেও যুদ্ধ বা অন্য কারণে দেশে ও বাইরে বন্দীদের অমানবিক অত্যাচার থেকে আইনী সুরক্ষা দিতে অগ্রণী হয়েছেন, শ্বেত শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে তিনি সকল মানুষের সমতায় জয়গান গেয়েছেন, রক্ষণশীলতার প্রতিভূ হয়েও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রচারিত বারাক ওবামার সময় গৃহীত সঙ্কুলানীয় চিকিৎসাসেবা আইন বা ওবামা কেয়ারকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সুরক্ষা দিয়েছেন। এ বছরের মার্চ মাসে ভিয়েতনাম সফরকালে আমি ম্যাককেইন হ্যানয়ের সন্নিকট যে হ্রদের যে স্থানে যুদ্ধবিমান থেকে ১৯৬৭ সালে আপতিত হয়েছিলেন সেখানে তার স্মৃতির প্রতি ভিয়েতনামীদের শ্রদ্ধা জানানোর লক্ষ্যে স্থাপিত ভাস্কর্য দেখেছি আর ভিয়েতনামের সঙ্গে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের জয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নের প্রচেষ্টার প্রেক্ষিতে ভিয়েতনামী নেতৃবৃন্দের উচ্ছ্বসিত স্বীকৃতি শুনে এককালীন শত্রুতার সর্বকালীন বন্ধুত্বে অবমুক্ত হওয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি রিপাবলিকান হয়েও ডেমোক্র্যাট দলের পুরোধা এডওয়ার্ড কেনেডির সহযোগে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন আইন সংশোধন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। আমি অভিভূত হয়েছি যখন দেখেছি তার স্ত্রী সিনডি কর্তৃক বাংলাদেশের অনাথ আশ্রম থেকে অসুস্থ এক বালিকাকে কোলে তুলে নেয়াকে তিনি হাসিমুখে সমর্থন করেছেন, নিজের মেয়ে বলে অন্য সন্তানের মতো সমঅধিকার দিয়ে ব্রিজিট নামে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে টেনে নিয়েছেন এবং এই বিষয়ে তার নিজ দল থেকে উচ্চারিত কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচার সত্ত্বেও কোনক্রমে এ পথ থেকে বিচলিত বা বিচ্যুত হননি। উল্লেখ্য, বুশের বিপক্ষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানরাই এই ব্রিজিটকে ম্যাককেইনের কৃষ্ণ মহিলার সঙ্গে বিয়ের বাইরে অবৈধ সম্পর্কজাত সন্তান হিসেবে কুৎসা রটিয়েছিলেন। তার নিবাস এরিজোনা অঙ্গরাজ্যের তার কফিনকে ঘিরে রাজধানী ফিনিফসে সেখানকার আইন পরিষদের কার্যালয়ে এবং পরে ওয়াশিংটনের কংগ্রেসের গণতান্ত্রিকতার নিলয়ে তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানান অগণিত মানুষ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দ। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অযৌক্তিক রক্ষণশীলতার কারণে তার শেষকৃত্যে তারই অভিপ্রায় অনুযায়ী আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স ট্রাম্পের তরফ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন যে, ম্যাককেইন জাতিকে সারাজীবন সেবা করে গেছেন। মেক্সিকান- আমেরিকান নেতা টমি ইসপিনজা বলেছেন, ম্যাককেইন সাদা, কালো, বাদামী, এশিয়ান সবাইকে বুঝতেন- তিনি জানতেন এদের সবাইকে নিয়েই আমেরিকা এক বড় জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ম্যাককেইন কোনদিন ঘৃণাকে তার হৃদয়ের বন্দরে ভিড়তে দেননি। আর ম্যাককেইন মৃত্যুর আগে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বারাক ওবামা (ডেমোক্র্যাট) ও জর্জ বুশকে (রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট যিনি ম্যাককেইনকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছিলেন) তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জনগণের তরফ থেকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করে গেছেন এবং তারা তাই করেছেন। স্বাধীনচেতা আমেরিকান হিসেবে ম্যাককেইন তার দলের প্রথাগত বা দর্শনভিত্তিক অবস্থানকে নিজের বিবেকের বিচারিক বিষয় বলে বিবেচনা করে স্বাধীনচেতা রাজনীতিবিদ হিসেবে পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং সম্ভবত তার জীবনের সংগ্রামে এই ছিল তার সবচেয়ে বড় বিজয়। ম্যাককেইনের মৃত্যুর দিন আমি যুক্তরাষ্ট্রের মুক্ত আঁতেল চিন্তার অন্যতম কেন্দ্র বস্টন-ক্যামব্রিজ এলাকায় ছিলাম। আমি দেখেছি ও অনুভব করেছি সকল মানুষ-ছাত্র-শিক্ষক, ছোট ক্যাফের মালিক, খাবার দোকানের সেবিকা, ক্যাব বা উবার চালক, পথচারী অবসরী জনগণ- সবাই শোকার্ত। টিভিতে দেখেছি সকল সরকারী, আধা সরকারী ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়েছে। সারা যুক্তরাষ্ট্র ছড়ানো শোকের ছায়া আমার অনুভূতিতে এসেছে। পত্রিকান্তরে তাকে স্বাধীনচেতা আমেরিকান ও আমেরিকান পুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে জাতীয় জীবনে তার মৃত্যুকে অপূরণীয় ক্ষতির ঘটনা হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস তার মৃত্যুর পর দিন তাকে হারিয়ে যাওয়া সিংহপুরুষ হিসেবে নামায়িত করেছে (দ্রষ্টব্য : নিউইয়র্ক টাইমস, আগস্ট ২৭, ২০১৮), বস্টন সানডে গ্লোব তাকে রাজনৈতিক স্বাধীন চিত্তরূপে আখ্যায়িত করেছে (দ্রষ্টব্য : বস্টন সানডে গ্লোব, আগস্ট ২৬, ২০১৮)। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন : আমাদের মতপার্থক্য সত্ত্বেও আমরা উচ্চতর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম- যে আদর্শের জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই প্রকৃতির আমেরিকানরা ও অভিবাসীরা সংগ্রাম করেছে, একসঙ্গে এগিয়ে গেছে এবং ত্যাগ স্বীকার করেছে। ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সাবেক গবর্নর মিট রমনী বলেছেন, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সাহসিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ম্যাককেইনের জীবন ও কর্মে সন্নিবেশিত ছিল। তিনি ছিলেন মহৎ গুণ ও নেতৃত্বের নিলয়- যা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে দীর্ঘতম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর ম্যাককেইনের আদরের দুলালী মেঘানের কথায়, তিনি আমাকে বড় করেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, সংশোধন করেছেন, স্বস্তি দিয়েছেন, সন্দিপীত করেছেন। তিনি ছিলেন এক বিশাল অগ্নিপুরুষ, যিনি জীবনের সংগ্রামী দহনে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে গেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮-এ গৃহীত এক প্রস্তাবে জন ম্যাককেইনের মৃত্যুতে সর্বসম্মতিক্রমে গভীর শোক প্রকাশ করেছে। বস্টনে টিভিতে দেখলাম সারাদেশের অর্ধনমিত জাতীয় পতাকার পরিম-লে হোয়াইট হাউসের জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়ছে। বলা হলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা অর্ধনমিত করতে দেননি। দুদিন পরে শুনলাম হোয়াইট হাউসে ওড়ানো জাতীয় পতাকা ট্রাম্প তার সহকর্মী ও সাধারণ মানুষের চাপে জন ম্যাককেইনের সম্মানার্থে অর্ধনমিতকরণে সম্মতি দিয়েছেন। জনগণের মূল্যায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রতিকূল পরিবেশও যে সঠিক মূল্যবোধকে বিজয়ী করে জন ম্যাককেইন তার আলমামিটার যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যন্ডের আনাপলিসে জাতীয় নৌবাহিনী একাডেমিতে ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮-এ শেষ শান্তির আশ্রয় নেয়ার আগে আজীবন প্রজাতন্ত্রী থেকেও গণতন্ত্রী শাসন ব্যবস্থায় বহুবাচনিক সমাজের সতেজ দৃষ্টির প্রতিভূ হয়ে চলে গেলেন। লেখক : রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী
×