ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

সরাসরি কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়া হতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৬ আগস্ট ২০১৮

 সরাসরি কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়া হতে পারে

এম শাহজাহান ॥ জাতীয় সম্পদ রক্ষায় সরাসরি কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়া হতে পারে। সঠিক মূল্য নির্ধারণে ট্যানারি মালিকদের ‘মনোপলি’ ব্যবসা ভেঙ্গে দিতে চামড়া বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা ভাবছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গত তিন দশকের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম দামে দেশে কাঁচা চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। পাঁচ হাজার কোটি টাকার এই ব্যবসা চলছে নিয়ম নীতিকে থোড়াই কেয়ার করে। সঠিক ও বেশি দাম পাওয়ার আশায় কাঁচা চামড়া পাচারের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বাস্তবতায় পাচার ঠেকাতে বৈধভাবেই কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি প্রদানের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া ব্যবসা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। মূল্য নির্ধারণ থেকে শুরু করে রফতানি বাজার নিয়ন্ত্রণ সবকিছু চলছে তাদের ইশারায়। কোরবানির আগে সরকারী সংস্থা ট্যারিফ কমিশন আন্তর্জাতিক বাজার যাচাই-বাছাই করে চামড়ার মূল্য নির্ধারণের জন্য একটি সুপারিশ তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল। ওই সুপারিশে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ঢাকায় ৫৫-৬০, ঢাকার বাইরে ৪৫-৫০, খাসির ২৫-২৭ এবং বকরির ২০-২২ টাকা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়। কিন্তু ট্যারিফ কমিশনের এই সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে ট্যানারি মালিকরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেকটা অসহায় পড়ে তাদের কাছে। অবশেষে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫ থেকে ৫০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া ১৮-২০ টাকা এবং বকরির ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করার ঘোষণা দেয়া হয়। মূল্য কমানোর পরও দেশের কোথাও সরকার নির্ধারিত এই দামে চামড়া কেনাবেচা হয়নি। সরকার নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেক দামও পায়নি কোরবানি দাতা, খুদে ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। ফলে চামড়ার দাম নিয়ে সকল পক্ষের মধ্যে অন্তোষ রয়েছে। দাম এত কমানো হয়েছে যে-এতিম, অসহায়, মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের লোকজনও এবার চামড়া সংগ্রহ করেনি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, চামড়ার বাজার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এটি জাতীয় সম্পদ, কিন্তু দাম নিয়ে শেষ পর্যন্ত যা হলো তা অশোভনীয় ও অমার্জনীয়। সরকার নির্ধারিত দাম দেশের কোথাও কার্যকর হচ্ছে না। আড়তমালিক, মৌসুমি ও খুদে ব্যবসায়ীরা ট্যানারি মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে। এমনকি যারা পশু কোরবানি দিয়েছেন অথচ চামড়ার ভাল দাম পাননি তাদেরও এ নিয়ে অসন্তুষ্টি রয়েছে। এই বাস্তবতায় কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি দেয়া হতে পারে। এতে একচেটিয়া ব্যবসার লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা সম্ভব। তিনি বলেন, আগে দেশ থেকে সরাসরি কাঁচা চামড়া রফতানি হতো। দেশীয় শিল্প বিকাশে সরকার ফিনিশড লেদার উৎপাদন ও রফতানিতে উৎসাহ দিয়ে আসছে। জানা গেছে, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে পর্যন্ত কাঁচা চামড়া বা ওয়েট-ব্লু লেদার এবং প্রক্রিয়াজাত চামড়া বা ক্রাস্ট লেদার রফতানি করা হতো। আর এখন বেশি রফতানি হয় ফিনিশড লেদার। দেশীয় জুতো শিল্পের বিকাশে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি বন্ধ রেখেছে। বরং বর্তমান ফিনিশড লেদার ও চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদেরের সময় কাঁচা চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেশন শুরু হলে রফতানির বিষয়টি ফের সামনে চলে আসে। ওই সময় জিএম কাদের কাঁচা চামড়া রফতানির কথা ঘোষণা করেন। এর পরই রফতানি বন্ধে ট্যানারি মালিকরা ঘোষণা দিয়ে কাঁচা চামড়ার দাম বাড়িয়ে দেন। তবে গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অজুহাতে কাঁচা চামড়ার দাম কমানো হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, গরিবের হক এই কাঁচা চামড়া অনেকটা বিনামূল্যে নিয়ে নিচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার এমনভাবে চামড়া কেনাবেচা হয়েছে শেষ পর্যন্ত ব্যবসার পুরোটা যাবে ট্যানারি মালিকদের পকেটে। কোরবানি দাতা থেকে শুরু করে তৃতীয় কোন পক্ষের লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। ভারতে কাঁচা চামড়া আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি দাম ॥ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে কাঁচা চামড়ার দাম বাংলাদেশের তুলনায় আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে এই দাম ছয় গুণের ওপর। এ কারণে সীমান্তে যতই কড়াকড়ি আরোপ করা হোক সঠিক দাম পাওয়ার আশায় চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কাঁচা চামড়া রাখতে হলে অবশ্যই সঠিক দামে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা হতে হবে। ট্যানারি মালিকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন করাতে হবে। এছাড়া এই শিল্পে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে চামড়া ব্যবসাটি একটি পারিবারিক ব্যবসায়ে রূপ নিয়েছে। পোশাকসহ অন্যান্য খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হলেও এই শিল্প খাতে কেউ এগিয়ে আসছে না। জানা গেছে, ভারতে কাঁচা চামড়ার মূল্য প্রতি বর্গফুট ১১০ থেকে ১২০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে তার দাম ন্যূনপক্ষে ২৪০-২৫০ টাকা। অথচ দেশে সেই চামড়া বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪০-৪৫ টাকায়। সরকার নির্ধারিত এই দামও কার্যকর হয়নি। মাঠ পর্যায়ে এবার প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়া ২০-২৫ টাকায় কেনা হয়েছে। এ অবস্থায় চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে কোরবানির চামড়া পাচার রোধে উত্তরের সীমান্তে রেড এলার্ট জারি করেছে বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ-বিজিবির পাশাপাশি পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঈদ-পরবর্তী ৩০ দিন পর্যন্ত এই রেড এলার্ট থাকবে। ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ ইতোমধ্যে চামড়া পাচারের আশঙ্কা করেছেন। ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়। বাংলাদেশ হাইডস এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে চামড়া পাচারের অভিযোগ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ট্যানারির মালিকদের কাছে কোটি কোটি টাকা পাওনা রয়েছে চামড়া ব্যবসায়ীদের। ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের পাওনা টাকা পরিশোধ করছে না ট্যানারির মালিকরা। এ কারণে আড়তদার ও ব্যবসায়ীরা টাকা দিতে পারছে না খুচরা ব্যবসায়ীদের। এটাও একটি বড় সমস্যা। নির্ধারিত দাম দেয়া হবে বিটিএ ॥ মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের যারা এখনও চামড়া বিক্রি করতে পারেননি, তাদের লোকসানের আশঙ্কা নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন বাংলাদেশ ট্যানারি এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, যারা মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী, তারা যদি চামড়াকে সঠিকভাবে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করেন, তাহলে সেটি দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত ভাল রাখা সম্ভব। এ সময়ের মধ্যে আমাদের ট্যানারির প্রতিনিধিরা সেগুলো ন্যায্য দাম দিয়ে কিনে নেবে। এজন্য তারা যেন তাড়াহুড়ো না করে, তা সে অনুরোধ করছি। শনিবার রাজধানীর জিগাতলায় বাংলাদেশ ট্যানারি এ্যাসোসিয়েশনের আয়োজনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, চামড়া সংগ্রহে আমাদের এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।
×