ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

আসামিরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে-রায়ের পর্যবেক্ষণ

পটুয়াখালীর ইসহাক সিকদারসহ ৫ জনের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১৪ আগস্ট ২০১৮

 পটুয়াখালীর ইসহাক সিকদারসহ ৫ জনের ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পটুয়াখালীর ইসহাক সিকদারসহ পাঁচ রাজাকারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ আদেশ প্রদান করেছে। ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর এটি হচ্ছে ৩৪তম রায়। ট্রাইব্যুনাল যাদেরকে ফাঁসি দিয়েছে তারা হলো ইসহাক সিকদার, আব্দুল গণি হাওলাদার, আব্দুল আওয়াল ওরফে মৌলভী আওয়াল, আব্দুস সাত্তার প্যাদা ও সোলায়মান মৃধা। আসামিরা কারাগারে আছেন। ট্রাইব্যুনাল রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে, আসামিরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, যা তাজা একটি বুলেটের চেয়েও ভয়ঙ্কর এবং শক্তিশালী। যিনি বা যারা এর শিকার হয়েছেন, সারা জীবন তাদের এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা বহন করতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যেসব মা-বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক (ওয়ার হিরো)। সময় এসেছে তাদের ওয়ার হিরো হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার। রায় ঘোষণার পর প্রসি্িকউশন পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী বলেছেন এ রায়ে আমরা খুশি হতে পারিনি। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপীল করলে ন্যায়বিচার পাবে। ট্রাইব্যুনাল রায় প্রদানের সময় প্রসিকিউশন পক্ষে ছিলেন, চীফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালূম, সৈয়দ হায়দার আলী, ঋষিকেশ সাহা, মোখলেছুর রহমন বাদল, সাবিনা ইয়াসমিন মুন্নী, তাপস কান্তি বল, রেজিয়া সুলতানা চমন রায়, মোঃ সুলতান মাহমুদ সিমন। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ও জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক সানাউল হক ছিলেন ট্রাইব্যুনালে। অন্যদিকে আসামি পক্ষে আব্দুর সাত্তার পালোয়ান ও আইনজীবী মোঃ আব্দুস সালাম খান উপস্থিত ছিলেন। ৩৪ মামলায় মোট ৭৮ আসামিকে দ- প্রদান করা হয়েছে। যার মধ্যে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে ৫২ জনকে, আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে ২৪ জনকে। আর একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান, একজনকে ৯০ বছরের দ-, একজনকে ২০ বছরের কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে ৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। একজনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে আপীল বিভাগে আপীলে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ২৩টি মামলা। এ রায় ঘোষণার পরেও বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে আরও ৩২টি মামলায় ১৩৪ রাজাকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন। প্রসিকিউশন পক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগ দায়ের করে ট্রাইব্যুনালে। দুটি অভিযোগই প্রমাণিত। প্রসিকিউশনের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, পাঁচ আসামির সবাই একাত্তরে ছিলেন মুসলিম লীগ সমর্থক। আর ২০১৫ সালে গ্রেফতার হওয়ার সময় তারা স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। তদন্ত সংস্থা ১৬টি অভিযোগ এনেছিল। পরবর্তীতে প্রসি্িকউশন পক্ষ দুটি অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালে। প্রথম অভিযোগে আটক নির্যাতন, লুটপাটসহ ১৭ জনকে হত্যা। দ্বিতীয় অভিযোগে আটক নির্যাতন ও ১৭ মহিলাকে ধর্ষণ। রায় ঘোষণার পর মামলার প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭১ সালের মে মাসে আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ১১ জনকে হত্যা এবং ১১ জনকে মারাত্মক জখম করে। প্রসিকিউশন যে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছে তাতে আসামিদের বিরুদ্ধে এসব অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে। এসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই আদালত পাঁচ আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- দিয়েছে। এ রায়ে প্রসিকিশন পক্ষ খুশি। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার পালোয়ান সাংবাদিকদের বলেন, আমি মনে করি রায়ে আমার মক্কেলরা ন্যায়বিচার পাননি। কারণ, এ মামলায় রেপ ভিকটিমসহ যে ১১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন, জবানবন্দীতে কোন সাক্ষী এই আসামিদের নাম-ঠিকানা বলেননি। তাই আমি মনে করি, আসমিরা আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সর্বোচ্চ আদালতে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করলে খালাস পাবেন। সোমবার সকালে আদালত বসার আগেই পাঁচ আসামিকে আগেই কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। বেলা পৌনে ১১টায় আদালত বসার পর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান কাঠগড়ায় উপস্থিত আসামিদের নাম জানতে চান। পরে ১৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার। বিচারপতি আমির হোসেন পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম সাজা ঘোষণা করেন।
×