ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৌশলী নাজমুল হোসেন

অভিমত ॥ চাকরির বয়স এবং ...

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২ আগস্ট ২০১৮

অভিমত ॥ চাকরির বয়স এবং ...

সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময় বাংলাদেশের লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের জীবন থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। তারা উৎকণ্ঠা আর হতাশায় ভুগছেন। বেকারত্বের হার দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। ফলে দেশ কখনওই বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখতে পারছে না। লাখ লাখ পিতা-মাতা সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করছেন। তাই একটাই যৌক্তিক দাবি- বয়স কেন বাধা হবে? আর কেনই বা আবেদনের ক্ষেত্রে বয়সসীমা বর্ধিত করা হবে না? চাকরির আবেদনে বয়সসীমা ৩০ বছর পর্যন্ত কেন এই প্রশ্নের উত্তরে হয়ত তেমন কোন যৌক্তিক উত্তর কেউ দিতে পারবে না। অথচ এই বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে রয়েছে কত শত যৌক্তিক কারণ। যেমন সেশন জট, নিয়োগ বাণিজ্য, পদ খালি থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না থাকা, যথাসময়ে নিয়োগ কার্যক্রম না হওয়া ইত্যাদি। এই সব অগোছালো ব্যবস্থার দায়ভার কে নেবে? নিয়মতান্ত্রিকভাবে সেসব দায়ভার সরকারের উপরই বর্তায়। কোন দেশের উজ্জ্বল আগামী বহুলাংশে নির্ভর করে তরুণদের ওপর। আর সেই তরুণদেরকেই যদি বয়স নামের প্রাচীরে আবদ্ধ করে রাখা হয় তাহলে দেশ উন্নয়নের পরিবর্তে সহজেই বিপরীতমুখী অবস্থান নিবে। তারাও চায় তাদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ। চায় আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার গর্বিত অংশীদার হতে। আমাদের দেশে সরকারী চাকরিতে প্রবেশসীমা ১৮ থেকে ৩০ বছর। পিএসসিসহ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্যান্য চাকরির প্রজ্ঞাপনে আবেদন করার বয়স এখনও ২১ বছর। অথচ ২১ বছরে পাবলিক বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রছাত্রীই ডিগ্রী বা স্নাতক পাস করতে পারে না। তাছাড়া ডিগ্রী আর স্নাতক কোর্সের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত এক বছর করে বাড়ানো হয়েছে। সনদ হাতে পেয়ে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অপেক্ষা আর চাকরির পরীক্ষার জন্য বাড়তি পড়াশোনা করতে করতে এই ৩০ বছর শেষ হয়ে যায়। কেউ কেউ সর্বোচ্চ একটা বা দুটা বিসিএস বা অন্যান্য সাধারণ সরকারী চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পায়। কিন্তু বেশিরভাগই সময়ের স্বল্পতার কারণে প্রতিযোগিতার এই বাজারে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। তাই বয়সের বাধায় তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। যাতে করে অনেকেই আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন, নিচ্ছেন। অন্যদিকে এই উচ্চশিক্ষিত তরুণরাই কর্মহীনতার কারণে নানা রকম অপরাধ কর্ম যেমন- মাদকদ্রব্য পাচার, সেবন ও বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জঙ্গী তৎপরতার ঘটনা তারই উদাহরণ। অন্যদিকে বর্তমান সরকার মাদক আইন ও জঙ্গী নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। অথচ এসব ঘটনার পেছনে কি কারণ রয়েছে তা খুঁজে বের করে সঠিক পদক্ষেপ নিলেই তার সমাধান হয়ে যায়। মূলত আমরা প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের কিছু দাবি যখন গণআন্দোলনে রূপ নেয় তখন এ নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত, প্রয়োজনীয় কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ২০১১ সালে গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সরকার বিদ্যমান প্রৌঢ় চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করেছিল এবং সেটা আরও বর্ধিতকরণের চিন্তাধারা রয়েছে বলেও জানা যায়। গড় আয়ু যখন ৪৫ ছিল তখন তখন প্রবেশের বয়স ছিল ২৭, সেটা বেড়ে ৫০ এর বেশি হলে প্রবেশের বয়স বেড়ে হয় ৩০। গড় আয়ু বাড়লে চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স দুটোই হারের ভারসাম্যতা রেখে বৃদ্ধি পাবে এই নিয়ম মানলে বর্তমানে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বা তার বেশি হওয়া শতভাগ যৌক্তিক ও উচিত। কারণ, বাংলাদেশের বর্তমান গড় আয়ু ৭২ বছর। ইদানীং প্রায়ই দেখা যায় বিশ্বের বহু দেশে উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশী তরুণদের আধুনিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার চিত্র আর পাশাপাশি নানা রকম আন্তর্জাতিক পুরষ্কার অর্জন। আপাত দৃষ্টিতে সেটা বাংলাদেশের মুখ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরারই একটা অংশ বিশেষ। তাই বলে নিজ দেশের কর্তার কি উচিত না নিজের এমন যোগ্য সন্তানকে দেশের কাজে, প্রজাতন্ত্রের কাজে লাগানো? কেন এমন যুগোপযোগী মেধার অবমূল্যায়ন হবে? এদেশের সরকার ও নীতি নির্ধারকরা আর আগের পুরনো ধ্যান-ধারণার মধ্যে নেই। অন্যান্য দেশের মতো আধুনিক উন্নয়নে সর্বক্ষেত্রের বিচারে আমরাও আজ অংশীদার। তাহলে চাকরির আবেদনে বয়সের বেলায় কেন আমরা আলাদা থাকব? প্রতিটা দেশই চাকরি ক্ষেত্রে তাদের আবেদনের বয়সসীমা সর্বনিম্ন ৩৫ থেকে ৫৯ পর্যন্ত রেখেছে। তাহলে আমরা কেন শুধু এই একটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকব? বয়স বৃদ্ধিকরণের আন্দোলন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি। কিন্তু সরকারের এই দাবিকে প্রাধান্য না দেয়া ও নীরব ভূমিকা পালন বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সচেতন সংস্থা বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখেই চলছে। তাহলে বাংলাদেশের নামের পাশে ‘উন্নয়নশীল দেশ’ নামক যে তকমা অর্জিত হয়েছে বাস্তবিক ক্ষেত্রে তার যুক্তি ও সার্থকতা কতখানি সেটাও কি বিবেচ্য বিষয় নয়? বয়স বাড়লেই মানুষ থেমে যায় না বরং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়। কারণ মানুষের মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা ও দক্ষতার মাত্রা বয়সের সঙ্গে বেড়ে চলে। দুঃখের বিষয় এটা প্রমাণ করার সুযোগটাই আমাদের দেশে নেই অথচ দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণীও এই পথেরই উত্তরসূরি। কিন্তু তাদের কতটুকু হতাশায় ও বুকে ছাই চাপা নীরব যন্ত্রণায় দিনাতিপাত ও মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে দেশকর্তা বা নীতিনির্ধারকদের সেদিকে কোন দৃষ্টি নেই। বিষয়টা আদৌ কতটা গুরুত্বের বা সমৃদ্ধিশালী ও বেকারমুক্ত দেশ গঠনের ক্ষেত্রে কতটা অন্তরায় সেটা বিবেচনায় আনা শতভাগ যৌক্তিক। প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার বলে একজন নাগরিক যে কোন সময় প্রজাতন্ত্রের কাজে নিয়োগ লাভ করতে পারবে আর সেটাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত বা নিয়ম। বাংলাদেশ সংবিধানের ‘সরকারী নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা’ অংশে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে-‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’ কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণই উল্টো নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে। দেশে দিন দিন বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত হারে বেড়েই চলছে। বিভিন্ন জরিপে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাটা একেক রকম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-২০১৭) অনুযায়ী এ দেশে বর্তমানে প্রায় ২৭ লাখ বেকার রয়েছে যার অর্ধেকেরও বেশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা চাকরি প্রত্যাশী। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক তথ্যানুযায়ী, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দফতরসমূহে বর্তমানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ পদ শূন্য রয়েছে। কিন্তু এই শূন্য পদগুলো পূরণেরও কোন উদ্যোগ নেই। অথচ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে আবেদনে বয়স বাড়িয়ে দিয়ে এই পদগুলো পূরণ করা যেত। অন্যদিকে গত ২৭ জুন সংসদে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে কমিটির সদস্যরা আশপাশের উন্নত দেশগুলোর চাকরির বিধি, বাংলাদেশের বর্তমান গড় আয়ু এবং ছাত্র-ছাত্রীদের তুলে ধরা বিভিন্ন যৌক্তিক দিকের সঠিক বিশ্লেষণ করে বয়স বৃদ্ধিকরণের এই বিষয়টিকে আমলে নিয়েছেন। এরপরই উক্ত বৈঠকের মাধ্যমে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ এবং অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছরে উন্নীতকরণের সুপারিশ করা হয় এবং পাশাপাশি এই সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। উপরোক্ত সর্বদিক বিবেচনাসহ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ প্রণীত ১৭টি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (এসডিজি) অর্জন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে চূড়ান্ত পর্যায়ের উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কাজে লাগানো দরকার বলে আমরা মনে করি। [email protected]
×