ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

আবার চাঁদে ফিরে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ২ আগস্ট ২০১৮

আবার চাঁদে ফিরে যাওয়া

১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মাঝে মধ্যেই মানুষের চন্দ্রাভিযানে চাঁদের বুকে প্রাণের স্পন্দন উঠেছিল। তারপর সহসাই চন্দ্রাভিযান বন্ধ হয়ে যায়। নিষ্প্রাণ চাঁদের বুকে আমার নিস্তব্ধতা, নীরবতা নেমে আসে। কিন্তু সেই অবস্থার শীঘ্রই পরিবর্তন হতে পারে। পাঁচ দশকের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি প্রাইভেট শিল্প ও আন্তর্জাতিক অংশীদারের সঙ্গে একত্রে চাঁদে ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত একটি দিক-নির্দেশনায় স্বাক্ষর দেন। কিন্তু আমেরিকার এবারের চন্দ্রাভিযান আগের বারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হবে। আগের বারের মতো শুধু ফ্ল্যাগ ও পদচিহ্ন রেখে আসা নয় গুটিকয়েক মানুষকে দু-চারদিনের জন্য পাঠিয়ে আবার ফেরত আসা নয়, এবারের অভিযানের উদ্দেশ্য চাঁদে ও তার আশপাশে দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করা এবং তার জন্য যে মূল কাঠামোটি নাসা গড়ে তুলতে চায় সেটির নাম লুনার অরবিটাল প্ল্যাটফর্মÑ ‘গেটওয়ে’। গেটওয়ে হবে চাঁদের কক্ষপথে এক ধরনের ক্ষুদে স্পেস স্টেশন। বর্তমানে যে ৪৫০ টন ওজনের ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন রয়েছে সেটির মতো নতুন স্টেশনটি অন্য ডজন খানেকেরও বেশি দেশের সাহায্যে নির্মিত হবে। তবে এটি হবে আকারে ছোটÑ মাত্র ৭৫ টন। এতে থাকবে বসবাস করার যোগ্য একটি বা দুটি মডিউল যার প্রতিটি একটি স্কুলবাসের সমান এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য কাজের জন্য আরও তিনটি মডিউল। তাছাড়া আগত নভোযান ভিড়বার জন্য একটি ডকিং পোর্ট। ‘গেটওয়ে’ চাঁদের কমসে কম ১২০০ মাইল এবং উর্ধে ৪৭ হাজার মাইল উপরে থেকে কক্ষ প্রদক্ষিণ করবে। নভোচারীরা এসে সেখানে একটানা ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারবে। সেখান থেকে তারা অবতরণ যানে করে চাঁদের বুকে নামতে পারবে আবার সেখান থেকে এই কেন্দ্রে চলে আসতে পারবে। এই অবতরণ যান বার বার ব্যবহার করা যাবে। চাঁদের কক্ষপথে প্রথম হার্ডওয়্যারটির পৌঁছার কথা ২০২২ সালে। একটি মানববিহীন রকেটে করে সেটা নেয়া হবে। গেটওয়েতে মানুষ গিয়ে বাস করবে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে। সেখান থেকেই পরবর্তীকালে তারা চাঁদের মাটিতে গিয়ে নামবে। নাসার এক কর্মকর্তা বলেন, ২০২০-এর দশকের মাঝামাঝি নাগাদ চাঁদে নভোচারী নামানোর লক্ষ্যে কাজ চলছে। চন্দ্রাভিযানের এই প্রকল্পটি সফল হলে পরবর্তী অভিযান মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর পথে তা হবে এক বিরাট পদক্ষেপ। এমনিতেও চাঁদ বৈজ্ঞানিক গবেষণার এক সমৃদ্ধ বিষয়। তার ওপর এটি মঙ্গলে বসতি স্থাপনের জন্য যা যা প্রয়োজন সেই সব ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। সোজা কথায় এই চন্দ্রাভিযান হবে মঙ্গল অভিযানের মহড়া। মঙ্গলগ্রহ যেতেই সময় লাগবে কমপক্ষে আট মাস। সেখানে পৃথিবী থেকে মাত্র তিন দিনের পথ চাঁদে গিয়ে বসবাসের অভিজ্ঞতা মঙ্গল অভিযানের কাজে লাগবে। গেটওয়ে মঙ্গলে যাওয়ার কলাকৌশল ভালভাবে রপ্ত করার চাইতেও বাড়তি আরও কিছু দেবে। দুই মেরুতে ধূলির স্তরের নিচে জমে থাকা বরফের কারণে চাঁদে পানি, বায়ু ও রকেট জ্বালানির উৎস হতে পারে। নভোচারীরা চাঁদের বরফ গেটওয়েতে নিয়ে আসতে পারে। সেখানে এর কিছুটা পানি হিসেবে মজুদ করে রাখা যাবে। বাকি যেটুকু বরফ থাকবে সেগুলোর হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মলিকুলগুলো ভেঙ্গে বের করে আনা যেতে পারে। মঙ্গলযাত্রী নভোচারীরা গেটওয়েতে থেমে তাদের যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় রসদপত্র নিতে পারবে। এতে করে পৃথিবী থেকে ওসব পাঠাতে হলে যে বিপুল জ্বালানি শক্তি ব্যয় হওয়ার এবং তার জন্য যে বিশাল খরচ হওয়ার কথা তা বেঁচে যাবে। দ্বিতীয় একটি মডিউল গেটওয়েতে ভিড়ানো রাখা যেতে পারে যেখানে মঙ্গলগামী যাত্রীরা যাওয়ার সময় মহাকাশে তাদের থাকার জায়গা প্রসারিত করার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে এবং ফিরে আসার সময় ছেড়ে আসতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে মঙ্গলগামী যে নভোযানটি গ্যাস ও রসদপত্র নেয়ার জন্য গেটওয়েতে থামবে তার তখনও মাত্রার ৯৯ শতাংশেরও বেশি পথ বাকি থাকবে। আর চন্দ্রগামী যে নভোযান গেটওয়েতে থামবে সেটি তার যাত্রার ৯৯ শতাংশ সম্পন্ন করে ফেলবে। তাহলে গেটওয়ে থাকার ফলে মঙ্গলযাত্রায় এমন লাভের লাভ কি হলো? মঙ্গলযাত্রায় সাহায্য করা যদি গেটওয়ের লক্ষ্য না হয় তাহলে লাভ অনেক আছে। এপোলো চন্দ্রপৃষ্ঠ যতটুকু উন্মোচন করতে পেরেছিল গেটওয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি স্থান উন্মোচন করতে পারবে। এপোলো নভোযান চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০ মাইল উপরে বিষুবরেখা বরাবর কক্ষ প্রদক্ষিণ করত এবং ওই অঞ্চলেই ল্যান্ডার নামাত। কিন্তু গেটওয়ের কক্ষপথটা হবে উপবৃত্তাকার এবং এর এমন কৌণিক অবস্থান হবে যে সেটি ইচ্ছামতো চাঁদের যে কোন জায়গায় ল্যান্ডার নামাতে পারবেÑ সেটা চাঁদের দূর প্রান্তে থেকে আর মেরু দেশে থেকে যেখানে এপোলোর কোন মিশন যেতে পারেনি। এ বছরের বসন্তে নাসা গেটওয়ের সোলার প্রোপালশন মডিউল তৈরির পরিকল্পনা পেশ করার জন্য লকহিড মার্টিন ও বোয়িংসহ ৫টি বৃহৎ কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ওই মডিউলটাই হবে মহাশূন্যে পাঠানো গেটওয়ের প্রথম অংশ। পাঠানো হবে ২০২২ সালে। এরপর পাঠানো হবে হ্যাবিটেশন মডিউল যা পাঠানো হবে ২০২৩ সালে। চাঁদে নামানোর মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য গেটওয়ের অবশ্য আরও অনেক অংশ প্রয়োজন হবে। এপোলো যুগে চন্দ্রপৃষ্ঠে নভোযান পাঠানোর জন্য নাসার মাত্র তিনটি প্রধান জিনিসের প্রয়োজন হতোÑ একটা রকেট, একটা অরবিটার ও একটা ল্যান্ডার। গেটওয়ে মিশনে পরিস্থিতি হবে আরও বেশি জটিল। কারণ, আগামী চন্দ্রাভিযানে মানুষ আরও দীর্ঘ সময় ধরে চাঁদের বুকে অবস্থান করবে। সে সময় চন্দ্র যাত্রার শুরু হবে এসএলএস বুস্টার রকেট দিয়ে। সেই রকেট আগের চন্দ্রাভিযানে ব্যবহৃত রকেটগুলোর মতোই বড়। ফ্লোরিডা থেকে এর যাত্রা শুরু হবে। এক সময় বুস্টার রকেটের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে সেটি তখন খসে পড়বে এবং ওরিয়ন নভোযান যাত্রীদের নিয়ে পথ চলতে থাকবে। এই ওরিয়ন নভোযানকে চাঁদে পৌঁছার জন্য ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯০০ মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে। ওরিয়নের ইঞ্জিন হবে এমন যে মাঝপথে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে পারবে। এটি যাত্রা শুরুর প্রায় তিন দিন পর চাঁদের কক্ষপথে স্থাপিত গেটওয়ে স্পেস স্টেশনে পৌঁছাবে। ওরিয়ন নভোযানে থাকবে নভোচারীদের মডিউল ও সৌর প্যানেল। গেটওয়ের উপবৃত্তাকার কক্ষপথটি হবে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ হতে ৪৭ হাজার মাইল পর্যন্ত। এটি পৃথিবী থেকে আগত নভোযানের মঞ্চ হিসেবে কাজ করবে। সেখানে পৌঁছার পর মানববাহী নভোযান মডিউলযোগে চাঁদে নামবে। আগে যেখানে কখনও নামা যায়নি বা সে সুযোগ ছিল না সেখানে নামবে নভোযান। পৃথিবীতে ফেরার পথেও মানুষ এই গেটওয়েতে যাত্রাবিরতি করতে পারবে। তবে চন্দ্রাভিযান আবার শুরু করাকে উত্তম ধারণা বলে মনে করলেও ‘গেটওয়ে’ যে সঠিক পথ সে ব্যাপারে সবাই একমত নয়। সমালোচকরা মনে করেন, কর্মসূচীকে কর্মসংস্থানের কর্মসূচী ও পানি ঢালার কর্মসূচী বলে মনে হয়। নতুন কোন প্রশাসন এলেই এ ধরনের কর্মসূচী। অনেক সময় নেয়া হয় যাতে করে জনগণকে এক নতুন স্বপ্ন দেখান যায়। চাঁদে যাওয়ার কিংবা দীর্ঘমেয়াদী মিশনে মঙ্গলে খাওয়ার জন্য এমন কর্মসূচী নেয়ার প্রয়োজন নেই বলে তারা মনে করেন। সূত্র : টাইম
×