ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মানবপাচার

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৩১ জুলাই ২০১৮

মানবপাচার

কাজের সন্ধানে কিংবা জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে মানুষকে যেতে হয় দেশ থেকে দেশান্তরে, দূর থেকে দূরান্তে। কিন্তু এই যাত্রাপথ খুব মসৃণ নয়। আবার জোরপূর্বক নর-নারী ও শিশু-কিশোরদের ধরে নিয়ে অন্য দেশে পাচার এবং বেচাকেনার ঘটনা ঘটেই চলেছে। অবশ্য সেই আদিকাল থেকেই প্রচলিত মানব পাচার বা দাস ব্যবসা। আর একালে নানা কায়দায়, নানারূপে বিভিন্ন প্রকরণ ও ছদ্মাবরণে মানবপাচার হয়েই চলেছে এবং তা আন্তর্জাতিক পরিম-লে পরিব্যাপ্ত। এমনটা হচ্ছে মূলত কর্মসংস্থানের অভাব বা বেকার সমস্যা থেকেই। জীবিকার জন্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের বাইরে যেতে চায়। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য অসহায় মানুষ স্থান থেকে স্থানান্তর হয়ে যায়। এই যে মানুষ পাচার হয়ে যাচ্ছে অজানার পথে, অচেনা জগতে, ভাগ্য তাদের পরিণত হচ্ছে দুর্ভাগ্যে। তা থেকে উদ্ধারের পথ বুঝি দূরস্ত। এ এক করুণ অবস্থা ও অবস্থান। মানবপাচার বাংলাদেশের অন্যতম শিরঃপীড়ায় পরিণত হয়েছে। জল-স্থল-আকাশপথে মানবপাচার চলছে নানা পথ ও পদ্ধতিতে। মূলত জীবন ও জীবিকার কারণে, দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে, দারিদ্র্যের পীড়নে, সচ্ছল জীবনযাপনের লক্ষ্যে মানুষ দেশান্তরী হচ্ছে। আবার এসব মানুষের বেশিরভাগই প্রতারিত হচ্ছে। হচ্ছে সর্বস্বান্ত। বাংলাদেশের দালালদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারীদের ভাল যোগসূত্র রয়েছে। মাফিয়াগোষ্ঠী এসব নিয়ন্ত্রণ করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেকার মানুষকে টার্গেট করে নীরবে পাচার চালায়। বিভিন্ন অচেনা দেশে কাজের নামে ভ্রমণ ভিসায় পাচার হচ্ছে মানুষ। কাজের কথা বলে নারীদের দেশের বাইরে পাঠানো হলেও তাদের কোন কাজ দেয়া হয় না। দিনের পর দিন তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। আবার বিদেশে জিম্মি করে দেশে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নিরীহ ও দরিদ্র নারীদের বিদেশে ভাল চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে এনে পাচার করে দেয় তারা। কারও ঠাঁই হয় ভারত ও পাকিস্তানে বা মধ্যপ্রাচ্যের পতিতালয়ে। কোথাও হয়ে যায় তারা যৌনদাসী। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এরা এখনও থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১২ সালে মানবপাচার আইন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত চার হাজার ১৫২টি মামলা হলেও শাস্তির ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। এসব মামলার অধিকাংশেরই এখন পর্যন্ত বিচার কার্যক্রমই শুরু হয়নি। পাচার রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় চলতি বছরও যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে পর্যবেক্ষণ তালিকায় রাখা হয়েছে। এমনিতেই মানবপাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যার নাম। বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো এ সমস্যায় নিত্যকার শিকার। বাংলাদেশের মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে চার শ’ নারী ও শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রধানত, মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, লেবানন, জর্দান ও সংলগ্ন দেশগুলোতে বাংলাদেশীরা পাচার হয়। মার্কিন মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে বাংলাদেশকে মানবপাচারের নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আদম ব্যবসায়ী আর দালালদের দৌরাত্ম্য সীমাহীন পর্যায়ে উপনীত দীর্ঘদিন ধরেই। তাদের হাতে নির্যাতিত নিগৃহীত নিঃস্ব হচ্ছে যারা, তারা দেশে এসেও তাদের বিরুদ্ধে মুখ পর্যন্ত খুলতে সাহস পায় না। এখন তো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা নয়া উপদ্রবে পরিণত হয়েছে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। এসব উদ্বাস্তু মানবেতর জীবন থেকে বাঁচার জন্য দেশান্তরী হতে গিয়ে মারাও যাচ্ছে। সেই আদিকাল থেকেই প্রচলিত মানবপাচার বা দাস ব্যবসা। আর একালেও মানবপাচারের অন্যতম লক্ষ্য থাকে নারী ও শিশু। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে মানবপাচার আইনকে কার্যকর করা জরুরী। কর্তৃপক্ষ যেন আর উদাসীন না থাকেন।
×