ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উজাড় হচ্ছে বন

মধুপুর বনের গাছপালা কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৯ জুলাই ২০১৮

  মধুপুর বনের গাছপালা  কেটে গড়ে তোলা  হচ্ছে স্থাপনা

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ৮ জুলাই ॥ দেশের তৃতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল মধুপুর বন। এ বনের ভূমি দখল করে ও লিজ নিয়ে বন ধ্বংস করছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা। সেখানে তারা গাছ কেটে চাষ করছে কলা, আনারস, হলুদ, লেবুসহ বিভিন্ন ফসল। ঘরবাড়ি ইত্যাদি স্থাপনাও তোলা হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের জন্য স্থানীয়দের মধ্যে ভূমি বরাদ্দ দেয়া হলেও কোন কোন সময় তারা গাছের পরিবর্তে কৃষি আবাদ করছে। এভাবে বনে কৃষিজমি দিনদিন বাড়ছে, নাই হয়ে যাচ্ছে গাছ। সরেজমিনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। মধুপুর উপজেলার পঁচিশ মাইল থেকে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ডান পাশে কিছু এগিয়ে মাটির রাস্তা চলে গেছে বনাঞ্চলের দিকে। বেরীবাইদ অঞ্চলের ছোট গাইজা, জাঙ্গালিয়া, মঙ্গলের দোকান, আঙ্গারিয়া, পচাচনা, গেচুয়া, নাগরমারাসহ কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, বনের ভেতর অনেক জায়গায় কৃষি আবাদ হচ্ছে। জাঙ্গালিয়ায় রাস্তার দুই পাশে আবাদ হচ্ছে কলা। এগিয়ে গেলে আঙ্গারিয়া গ্রামের রাস্তার পাশে টিনশেড বিল্ডিং, সামনে খোলা জায়গা। এর সামনে আরও বড় জায়গায় লাগানো হয়েছে কলার চারা। স্থানীয়রা জানায়, এসব জায়গা একটি বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) লিজ নিয়েছে। তারাই আবাদ করছে। মাটির রাস্তা দিয়ে গেলে পচাচনা গ্রামে দুটি বিশাল প্লটে আবাদ হচ্ছে আনারস। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ওই জায়গা স্থানীয় নয়ন গারোর। তিনি অনেক দিন ধরে আবাদ করছেন। বনে এভাবে আবাদ হচ্ছে বলতেই তারা বলেন, গাছ লাগানো বাদ দিয়ে মানুষ নিজের জায়গার সঙ্গে বনের জায়গাতেও আনারস-কলা চাষ করে। পচাচনা গ্রামেই দেখা যায়, খানিকটা জায়গায় বনের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে গোড়ার পুরনো অংশ রয়েছে। এর পাশেই নিচু ক্ষেত। বনের আরেক অংশ আগুনে পোড়া। স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি আবুল কাশেম বলেন, প্রথমে বনের কিছু অংশে আগুন লাগানো হয়। পরে গাছগুলো কাটা হয়। তারপর সেখানকার মাটি কেটে নিচু করে আবাদ শুরু হয়। এভাবে জমিটি দখলদারের হয়ে যায়। স্থানীয়রা আরও বলেন, আগে কুড়াল দিয়া গাছ কাটা হতো। এখন করাত দিয়া কাটা হয়। আগে বন গাছে ভর্তি আছিল। এরশাদ সরকারের আমলে গাছ কাটা হয় বেশি। সেই কাটা এখনও বন্ধ হয় নাই। যার ক্ষমতা বেশি, সে তত বেশি গাছ কেটে দখল করে। বেরীবাইদের মকবুল হোসেন বলেন, এরশাদ সরকারের আমলে একটা গাছ কেটে আটটি গাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয় বন এলাকায় বসবাসকারীদের। তখন গাছ কাটা হলেও গাছ লাগানো হয় নাই। এখনও চলছে গাছ কাটা। অনেকে সরকারী প্লট নিয়ে গাছ লাগানো বাদ দিয়ে ফসল আবাদ করছে। সরকার চাইলে এখনও বন রক্ষা করা সম্ভব। অভিযোগ রয়েছে, এসব দখল ও আবাদ বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমেই করা হয়। টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, সুন্দরবন ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চলের পরে মধুপুর গড়াঞ্চলের অবস্থান। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ অঞ্চল মিলে মধুুপুর গড়াঞ্চলের আয়তন ৬০ হাজার একর। বিগত ১৯৮৮ সালে ৪৫ হাজার ৫শ’ একর বনভূমি নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইলের বনভূমিকে পৃথক করা হয়। বিগত ১৯৯০ সালে বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, মধুপুর গড়ের টাঙ্গাইলের অংশে ২৮ হাজার ৪৩৮ দশমিক ৪৭ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। দখলের আওতায় আদিবাসী অধ্যুষিত ১৮টি গ্রামসহ ৩৩টি গ্রামের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবার রয়েছে। বন কর্মকর্তারা জানান, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ভূমির চাহিদা বাড়ে। তখন তারা (দখলকারীরা) তাদের বসতবাড়ি ও কৃষিজমি অবৈধভাবে সম্প্রসারণ করতে থাকে। ৬০ বছর ধরে এ প্রক্রিয়া চলছে। বনের ভেতর বসবাসকারী গরিব মানুষ কিছু জায়গা দখল করলেও প্রভাবশালী মহল শতশত একর বনভূমি দখল করেছে। জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক জানান, পচাচনা গ্রামে প্রায় এক হাজার ২শ’ শতাংশ জমি ১৫ আদিবাসী কিনে আবাদ করছে। নয়ন গারো সেগুলো দেখাশোনা করেন। ৩০ বছর আগে সেসব এলাকায় বন ছিল। স্থানীয় বাঙালীরা আস্তে আস্তে দখলে নিয়ে আবাদ শুরু করে। পরে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে তারা মালিকানা হস্তান্তর করে আদিবাসীদের কাছে। এর বৈধ দলিল নেই। তবে সেখানে ব্যক্তি বা যৌথ উদ্যোগে আবাদ হচ্ছে। প্রভাবশালীরা নামে-বেনামে জমি দখল করে অন্যদের দিয়ে চাষ বাস করায়। এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও নয়ন গারোকে পাওয়া যায়নি। মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, মধুপুরে ২৬ হাজার ৫৩০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। বন বিভাগের দখল হওয়া অনেক জমিতে হয়ত কলা, লেবু, আনারস আবাদ হচ্ছে। কিন্তু সেসব তথ্য কৃষি বিভাগে নেই। টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ খান বলেন, দখলকারীদের বনাঞ্চলের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ক উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে দখলকৃত বনভূমি বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছে। গাছ চুরিতে বা বনের ক্ষতিসাধনে জড়িতদের চিহ্নিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে।
×