ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিশু রাইফার মৃত্যু

দায়ী চিকিৎসকের অবহেলা ও ম্যাক্স হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৭ জুলাই ২০১৮

 দায়ী চিকিৎসকের অবহেলা ও ম্যাক্স হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে সাংবাদিক রুবেল খানের আড়াই বছরের শিশুকন্যা রাফিদা খান রাইফার মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসকের অবহেলা এবং ম্যাক্স হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার বিষয়টিই বেরিয়ে এসেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। জেলা সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট প্রদান করেছে, তা শুক্রবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরেছে সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে)। প্রতিবেদনে হাসপাতালের ৩ চিকিৎসককে দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালটির সার্বিক ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অতিসত্বর সংশোধন করা প্রয়োজন বলে অভিমত রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডাঃ প্রণব কুমার চৌধুরী এবং সিইউজে’র যুগ্ম সম্পাদক সবুর শুভ’র নেতৃত্বে গঠিত হয় এই তদন্ত কমিটি। কমিটি রাইফার বাবা-মা, ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকসহ মোট ১২ জনের বক্তব্য গ্রহণ করে। সকলের বক্তব্য এবং হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুকন্যা রাইফা খান যখন তীব্র খিচুনিতে আক্রান্ত হয়, তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অনভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। ওই সময়ে থাকা সংশ্লিষ্ট নার্সদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও এ রকম জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো দক্ষতা বা জ্ঞান কোনটাই তাদের ছিল না। রাইফা খানকে অসুস্থতার জন্য ম্যাক্স হাসপাতালে জরুরী বিভাগে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে শেষ চিকিৎসা পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের ভোগান্তি চরমে ছিল। শিশু চিকিৎসক ডাঃ বিধান রায় চৌধুরী শিশুটিকে যথেষ্ট সময় ও মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করে দেখেননি। ডাঃ দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও ডাঃ শুভ্রদেব শিশুটির রোগ জটিলতার বিপদকালীন সময়ে আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা প্রদান করেননি বলে শিশুর পিতা-মাতা যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তা সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। তদন্তে স্পষ্ট হয় যে, হাসপাতালে রোগীর ভর্তি প্রক্রিয়ায় ভোগান্তি প্রকট। চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা প্রদানে সমন্বয়হীনতা ও চিকিৎসাকালীন মনিটরিংয়ের অভাব দেখা যায়। অদক্ষ নার্স ও অদক্ষ চিকিৎসক নিয়োগের ফলে কাক্সিক্ষত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অনেক দুর্বল রয়েছে। বিশেষত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবায় বিশেষজ্ঞের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির সঙ্কটটি প্রবল। সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি বেশ ক’টি সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে- চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ম্যাক্স হাসপাতালের সার্বিক ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অতি দ্রুত সংশোধন করা অপরিহার্য। কর্তব্যরত নার্সগণ সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ডিপ্লোমাধারী হওয়ার নিয়ম থাকলেও এই হাসপাতালে তা নেই। ডিপ্লোমা নার্স দ্বারা চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক দ্রুত ও আন্তরিক সেবা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং রোগীর অভিভাবককে যথাসময়ে রোগীর অবস্থা ও চিকিৎসার বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবগত করতে হবে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডাঃ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বৃহস্পতিবার রাতে এ তদন্ত প্রতিবেদন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নাজিমুদ্দীন শ্যামলের কাছে হস্তান্তর করেন। শুক্রবার সকাল ১১টায় এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরেন সিইউজে’র সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি শহীদ উল আলম, সিইউজে’র সাবেক সভাপতি এজাজ ইউসুফী, মোস্তাক আহমেদ, রিয়াজ হায়দার চৌধুরী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি মনজুর কাদের মঞ্জু, সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, বিএফইউজে’র যুগ্ম-মহাসচিব তপন চক্রবর্তী, সিইউজে’র যুগ্ম-সম্পাদক সবুর শুভ, সিনিয়র সাংবাদিক অরুন দাশগুপ্ত, নজরুল ইসলাম, মোঃ শামসুল ইসলাম, মহসিন কাজী, উজ্জ্বল ধর, উত্তম সেনগুপ্ত, মাসুদুল হক প্রমুখ। উল্লেখ্য, দৈনিক সমকালের স্টাফ রিপোর্টার রুবেল খানের কন্যা রাইফা গলা ব্যাথা ও জ্বরে আক্রান্ত হলে তাকে চট্টগ্রাম নগরীর মেহেদীবাগে অবস্থিত ম্যাক্স হাসপাতাল প্রাইভেট লিমিটেডে ভর্তি করা হয়। প্রথমে প্রয়োগ করা এন্টিবায়োটিকে শিশুটি অস্বস্তি বোধ করলে তা অবহিত করা হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এরপর শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ বিধান রায় চৌধুরীর টেলিফোনে দেয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তাকে সেডিল ইনজেকশন দেয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রচন্ড খিচুনিতে শিশু রাইফার দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং একপর্যায়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ঘটনার পরই রাইফার বাবা-মা এবং অভিভাবকরা ভুল চিকিৎসা, অবহেলা এবং হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আনেন। এ নিয়ে অনেকটা মুখোমুখি পর্যায়ে চলে যায় সাংবাদিক সমাজ এবং চিকিৎসকদের একটি অংশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তদন্তে অভিভাবকের পক্ষ থেকে তোলা অভিযোগই সত্য প্রমাণিত হলো।
×