ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মৌসুমি কালো জাম

সুস্বাদু জনপ্রিয় ঔষধি ফল- যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩ জুলাই ২০১৮

সুস্বাদু জনপ্রিয় ঔষধি ফল- যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ মধুমাসের অন্যতম সুস্বাদু ফল জাম। দেশের অন্য সব মৌসুমি ফলের তুলনায় জামের স্থায়িত্বকাল তুলনামূলক কম হলেও এটি পুষ্টিগুণে অতুলনীয়। গ্রীষ্মকালীন কালোজাম গাছের উদ্ভব দক্ষিণ এশিয়া, আন্দামান ও ফিলিপিন্স দ্বীপপুঞ্জে। বাংলাদেশ ছাড়াও পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া এ সকল ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। এ দেশে, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, গাজীপুর, সিলেট, ঢাকা, দিনাজপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় জাম বেশি উৎপন্ন হয়। জাম সাধারণত তাজা ফল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ফল থেকে রস এবং সংরক্ষিত খাদ্য তৈরি করা যায়। জাম নানা দেশে নানা নামে পরিচিত। যেমন- জাম্মুল, জাম্বু, জাম্বুলা, জাভা, প্লাম, জামুন, কালোজাম, জামব্লাং, জাম্বোলান, কালো গ্লান, ড্যানসন প্লাম, ডুহাট প্লাম, জাম্বোলন প্লাম, পর্তুগিজ প্লাম ইত্যাদি। ভেলেগু ভাষায় একে বলা হয় নেরেদু পান্ডু, মালায়ালাম ভাষায় নাভাল পাজাহাম, তামিল ভাষায় নাভা পাজহাম এবং কানাডা ভাষায় নেরালে হান্নু। ফিলিপিন্সে একে বলা হয় ডুহাট। এটি দেখতে ২.৫ সেন্টিমিটার লম্বা, প্রায় আয়তাকার। জাম গাছ ১৪ ফুট থেকে ৬০ ফুট বা এরচে’ বেশিও লম্বা হয়। পাতা সরল, বড়, চামড়া পুরু ও চকচকে। এর পাতা সবুজ, চকচকে। এ কারণে এর আলংকারিক মান বেশ ভাল। জাম গাছে মার্চ-এপ্রিল মাসে ফুল আসে। জামের ফুল ছোট এবং ঘ্রাণযুক্ত। মে-জুন মাসে এর ফল বড় হয়। ফল দেখতে লালচে এবং ডিম্বাকার। শুরুতে এটি সবুজ থাকে, যা পরে গোলাপি হয়। জাম পাকলে কাল বা কালচে বেগুনি হয়ে যায়। এই ফল খেলে জিহ্বা বেগুনি হয়ে যায়। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার সালটিয়া ইউনিয়নের কালেরহাট গ্রামে জামের পাইকারি বাজারে কথা হয় ব্যবসায়ী বাদল মিয়া, কাজল মিয়া ও সাগর মিয়ার সঙ্গে। তারা জানান, প্রতি বছর গফরগাঁওয়ের জামের এই পাইকারি হাট থেকে লাখ লাখ টাকার জাম রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এবং দেশের বাইরে মধ্যপাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। ব্যবসায়ী বাদল মিয়া বলেন, আমরা এই এলাকার একেকটি বাগানের তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার গাছ ক্রয় করি। পরে সেই গাছ থেকে শ্রমিক দিয়ে জাম এনে ট্রাকে করে ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এক মন জামের দাম পাইকারি বাজারে ৩ হাজার ৮শ’ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা হলেও ঢাকায় একই জাম আমরা বিক্রি করি ৪ হাজার ২শ’ টাকা থেকে ৪ হাজার ৮শ’ টাকা পর্যন্ত। চলতি মৌসুমে গফরগাঁওয়ের জামের পাইকারি বাজার থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকার জাম আমদানি ও রফতানি করা হয়েছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, জাম ভারতবর্ষ থেকে সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং বর্তমানে এটি সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে বেশ দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রধানত দুই জাতের জাম পাওয়া যায়। জাতগুলো হলো ক্ষুদি বা খুব ছোট জাত এবং মহিষে বা বেশ বড় ও মিষ্টি জাত। এটি বর্ষাকালেই পাওয়া যায়। এই ফলের গা কালো এবং খুব মসৃণ পাতলা আবরণ দিয়ে ঢাকা। ফলের বহিরাবরণের ঠিক নিচ থেকে গাঢ় গোলাপী রঙের টক মিষ্টি শাঁস। জামের প্রধান ব্যবহার খাদ্য হিসেবে। টক মিষ্টি সুস্বাদু এই ফলটি বেশ জনপ্রিয়। কবিরাজি বা হেকিমী চিকিৎসায় এর কিছু ব্যবহার আছে। বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ, ভারতবর্ষ, ইন্দোনেশিয়া এবং চীন দেশে জামের ব্যবহার হয়ে আসছে। জামের বীজ দিয়ে নানান রোগের আয়ুর্বেদী চিকিৎসা করা হয়Ñ যেমন বহুমুত্র। ইউনানী এবং চৈনিক চিকিৎসাতেও এর ব্যবহার আছে। হজমের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, মাড়ির প্রদাহ, ক্যান্সার প্রতিরোধে কালোজাম, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন নিয়ন্ত্রণ, হার্টের সমস্যা এবং রক্ত আমাশয়ও ভাল কাজ করে কালোজাম। ইত্যাদি রোগে জামের বীজ, ছাল ও পাতা ব্যবহৃত হয়। জাম থেকে মদ ও সিরকা তৈরি করা যায়। জামে বেশি পরিমাণে ভিটামিন এ এবং সি আছে। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন আরও বলেন, জামে ফাইটো কেমিক্যালস আর এ্যান্টি অক্সিডেন্ট বিদ্যমান- যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সঙ্গে মৌসুমি সর্দি-কাশি থেকেও মুক্তি দেয় এবং প্রতিরোধ করে ইনফেকশনের মতো সমস্যারও। বৃদ্ধ বয়সে চোখের অঙ্গ ও স্থায়ুগুলোকে কর্মময় করতেও সাহায্য করে জাম। এমনকি চোখের সংক্রামণের (ছোঁয়াচে) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কালোজাম। রাতকানা এবং চোখের ছাউনীতেও জাম সহায়ক। গফরগাঁওয়ের খায়রুল্লাহ সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক জাহিদুর রহিম (জাহিদ) ও নূরুজ্জামান বলেন, নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশী ফল জাম। তাই নানা কারণে এই ফল এখন চলে গেছে দামী ফলের তালিকায়। একসময় যত্রতত্র প্রচুর জামগাছ চোখে পড়লেও এখন আর তেমন দেখা যায় না। ঔষধি গুণসম্পন্ন পাকা জামের মধুর রসে এখন আর মুখ আগের মতো রঙিন হয় না। পতিত জায়গাগুলোতে জামের চারা রোপণ করে একদিকে যেমন আমাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব-তেমনি অন্যদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। ঔষধি গাছ হিসেবে জামগাছের ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত।
×