ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে ১০টি বৃহৎ উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৩ জুলাই ২০১৮

দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে ১০টি বৃহৎ উদ্যোগ

(গতকালের পর) শ্রম আইন ও বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালার সংশ্লিষ্ট বিধানাবলী বাস্তবায়নকল্পে শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল গঠনের লক্ষ্যে সোনালী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখায় ‘সেন্ট্রাল ফান্ড (আরএমজি সেক্টর)‘ শীর্ষক হিসাবে শতভাগ রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যাদেশের বিপরীতে প্রাপ্ত রফতানি মূল্যের দশমিক ৩ শতাংশ হারে কর্তনপূর্বক ৭ দিনের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট হিসাবে স্থানান্তর করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া স্কিল ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রামের (এসইআইপি) আওতায় পোশাক শিল্প শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় তিন বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রশিক্ষণের ফলে এ খাতের শ্রমিকদের কর্মদক্ষতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনাথ আশ্রম কর্মসূচী এতিম শিশুদের প্রতিপালন, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালে এতিম এবং বিধবা-সদন আইন প্রণীত হয়। এ আইনে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় জেলা ও থানা সদরে সরকারী এতিমখানা চালু করা হয়। আর এসব এতিমখানাকে পরবর্তীকালে শিশুসদন এবং বর্তমানে শিশু পরিবার হিসেবে রূপান্তরের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৩টি এবং এসব প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য এতিম ছেলেমেয়ে প্রতিপালন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য উপায়ে আর্থ-সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ১৬৩০টি বেসরকারী এতিমখানার পরিচালনার দায়িত্ব ১৯৬১ সালে শিক্ষা দফতর হতে সমাজকল্যাণ পরিদফতরে ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে সরকারী এতিমখানার নামকরণ করা হয় সরকারী শিশু সদন। সমাজসেবা অধিদফতর জাতি গঠনমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শিশুকল্যাণ ও উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। শিশুদের কল্যাণ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন, সাংবিধানিক অঙ্গীকার, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেয়া প্রতিশ্রুতিকে সমাজসেবা অধিদফতর অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে শিশুকল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য টেকসই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বর্তমানে পারিবারিক পরিবেশে এতিম শিশুদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও সাহচর্য প্রদানের মাধ্যমে প্রতিপালনের জন্য শিশু সদনগুলোকে সরকারী শিশু পরিবারে রূপান্তরের কাজ অব্যাহত আছে। ২০১১ সালে নতুন ৯টি শিশু পরিবার স্থাপন করা হয়েছে। শিশু সদন/শিশু পরিবারে দরিদ্র পরিবারের ৬ বছর হতে ৯ বছর বয়সী এতিম ছেলেমেয়েরা ভর্তির যোগ্য। অনাথ আশ্রম কর্মসূচী দুটি ধারায় কাজ করছে। প্রথমটি হলো সরকার কর্তৃক পরিচালিত শিশু পরিবার আশ্রম এবং দ্বিতীয়টি বেসরকারী অনাথ আশ্রম। প্রথমটির আওতায় প্রায় দশ হাজার অনাথ শিশু সুবিধা ভোগ করে। দ্বিতীয়টির সুবিধাভোগীদের সংখ্যা প্রায় ৪৫০০০। প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় দরিদ্র, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী শিশু কিশোরদের শিক্ষা লাভের জন্য এই শিক্ষা উপবৃত্তি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এই উপবৃত্তি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে। তারা নিজের পড়াশোনার খরচ ও বইপত্র নিজেই কিনতে পারবে। প্রতিবন্ধী বলে সে সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না, অর্থের অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হবে না। পড়াশোনা শেষে নিজের জন্য ও পরিবারের জন্য কিছু করার সুযোগ পাবে। প্রতিবন্ধী ছাত্রভাতা সব পর্যায়ের প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী এ কর্মসূচীর আওতাভুক্ত। ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তির হার বাড়িয়ে প্রাথমিক স্তরে ৫০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৭০০ টাকা হতে ৮৫০ টাকায় উন্নীত করার পাশাপাশি ভাতাভোগীর সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজারে উন্নীত করা হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প’ সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ভর্তিকৃত সকল ছাত্র-ছাত্রীর মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে সরকারের এক ইতিবাচক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রকল্পটি ২০০২ সালে গ্রহণ করা হয়েছিল। বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন ‘প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প’ পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনসহ দেশের সকল এলাকার শতভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মায়েদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হার বৃদ্ধি, উপস্থিতি বৃদ্ধি, ঝরে পড়ার হার রোধ, শিক্ষাচক্রের সফল সমাপ্তির হার বৃদ্ধি, পুনরাবৃত্তির হার হ্রাসকরণ, শিশু শ্রম রোধ, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার এবং প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি প্রদান কর্মসূচি সরকারের যুগান্তকারী প্রকল্পগুলোর অন্যতম। বর্তমানে সারাদেশে এ স্তরে উপবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ। প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্প-৩য় পর্যায় এর মূল প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ছিল জুলাই ২০১৫ থেকে জুন ২০১৭ পর্যন্ত। পরে একে সংশোধন করে বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০১৫ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ করা হয়েছে। এতে মূল প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৬৭ কোটি ৩৯ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৬ হাজার ৯২৩ কোটি ৬ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ দেশের সকল উপজেলার প্রাথমিক পর্যায়ের ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান করা হবে। হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপবৃত্তি হিজরা বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। সমাজসেবা অধিদফতরের জরিপমতে বাংলাদেশে প্রায় ১৩,২৯,১৩৫ জন অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং ৭৫,৭০২ জন বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। অনগ্রসর এ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র-উপগোত্রে বিভক্ত। যাযাবর জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। বেদে জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলিম এবং শতকরা ৯০ ভাগ নিরক্ষর। ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে পাইলট কর্মসূচীর মাধ্যমে ৭টি জেলায় এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলায় হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপবৃত্তি কর্মসূচী সম্পসারণ করা হয়েছে। স্কুলগামী বেদে ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ৪ স্তরে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপবৃত্তির হার প্রাথমিক স্তরে ৩০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা, মাধ্যমিক স্তরে ৪৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায়, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা এবং উচ্চতর স্তরে ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। অনগ্রসর এ সম্প্রদায়সমূহের ৫০ বছর বা তদুর্ধ বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল ব্যক্তিকে বিশেষ ভাতা হিসেবে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা, প্রশিক্ষণোত্তর পুনর্বাসন সহায়তা ১০,০০০ টাকা প্রদান করা হচ্ছে। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপকারভোগীর সংখ্যা ৩৬ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৬৪ হাজার এবং এদের মধ্যে বিশেষ ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৩ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৪০ হাজার এবং শিক্ষা উপবৃত্তির সংখ্যা ১১ হাজার থেকে ১৯ হাজারে উন্নীত করা হয়েছে। দারিদ্র্য ও অসমতা হ্রাসের ক্ষেত্রে নিয়মিত অর্থনৈতিক কর্মকা-ের বাইরে শেখ হাসিনার যুগান্তকারী এ উদ্যোগে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূলস্রোত ধারায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য খেতাবপ্রাপ্ত, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবার মিলিয়ে মোট ৮ হাজার ৫১৪ জনকে ভাতা দেয়া হয়। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেয়া শুরু হয় ২০১৩ সাল থেকে। প্রত্যেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা মাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পান। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের মাসিক ভাতা ৩৫ হাজার টাকা। ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা মাসিক ৩০ হাজার টাকা, বীরউত্তমদের ভাতা ২৫ হাজার টাকা, বীরবিক্রমদের ভাতা ২০ হাজার টাকা এবং বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের ভাতা ১৫ হাজার টাকা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা আগামী অর্থবছর থেকে প্রত্যেকে বছরে মাসিক সম্মানীর সমপরিমাণ দুটি উৎসব ভাতা, দুই হাজার টাকা করে বাংলা নববর্ষ ভাতা, দুই হাজার টাকা বিজয় দিবস ভাতা পাবেন। দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে সরকারের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা পান। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়ের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের আবেগ-অনুভূতি বিবেচনায় সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে। অসচ্ছল যুদ্ধাহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা অথবা নাতি-নাতনিদের সহায়তা দেয়ার জন্য বাজেটে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রয়েছে। প্রায় দশ হাজার উপকারভোগী এ বেষ্টনীর আওতাভুক্ত। ভিজিডি কার্যক্রম ভিজিডি কর্মসূচী বাংলাদেশ সরকারের একটি সর্ববৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচী। দুস্থ ও অসহায় এবং শারীরিকভাবে সক্ষম মহিলাদের উন্নয়ন স্থায়ীত্বের জন্য খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে উন্নয়ন প্যাকেজ সেবার আওতায় নির্বাচিত এনজিওর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এই কর্মসূচীর উপকারভোগীরা ১০০% মহিলা। প্রতিটি চক্র দুই বছর অর্থাৎ ২৪ মাস মেয়াদী। ২০১১-২০১২ সাল থেকে প্রকল্পটি শুরু হয়েছে। বর্তমানে ৪৮৮টি উপজেলায় ভিজিডি উপকারভোগীর মোট সংখ্যা ১৫ লাখ। ৪৮৮টি উপজেলার ভিজিডি উপকারভোগীকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল প্রদানের পাশাপাশি সঞ্চয়ের জন্য মাসে ২০০ টাকা প্রদান করা হয়। অর্থ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা এবং সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার সরকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। এছাড়াও ভিজিডি উপকারভোগী মহিলাদের উন্নয়ন প্যাকেজ সেবার আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ৬৪টি জেলায় নির্বাচিত এনজিওরা প্রশিক্ষণ, সামাজিক সচেতনতা, আয়বর্ধক উদ্যোক্তা উন্নয়ন, সঞ্চয় এবং চাহিদার ভিত্তিতে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করছে। উপকারভোগী মহিলা ইচ্ছা করলে এনজিওদের নিকট হতে ঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে পারে। সেক্ষেত্রে এনজিও তাদের উৎপাদন, বাজারজাত ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করে থাকে। সাময়িক বেকারত্ব দূরীকরণ কর্মসূচী সাময়িক বেকারত্ব দূরীকরণ কর্মসূচীর আওতায় দেশের উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় সাময়িক বেকার ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য এ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিল। সাময়িক এ বেকারত্ব সমস্যাটি ‘মঙ্গা’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে সরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা কর্মসূচী বাস্তবায়নের ফলে দেশের কোথাও মঙ্গা পরিস্থিতির মতো ভয়াবহ অবস্থা আর নেই। এসব এলাকার মানুষ তাদের আর্থিক দুরাবস্থা কাটিয়ে স্বাবলম্বী জীবনযাপন করছে। এ ছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আপদকালীন সময়ে দেশব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর আওতায় গ্রামীণ শ্রমিকদের কাজ প্রদানের জন্য শ্রমঘন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে অতিদরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার, গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি। অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী (ইজিপিপি) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রাণালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচী সরকারের একটি চলমান সফল কর্মসূচী। এই কর্মসূচীর মাধ্যমে মন্দা মৌসুমে অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য বছরে দুটি চক্রে ৮০ দিনের কাজের সংস্থান করা হয়। তবে সরকার প্রয়োজনবোধে সময়সূচী হ্রাস/বৃদ্ধি করে থাকে। এ কর্মসূচীর লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অতিদরিদ্র পরিবারের জন্য খ-কালীন কাজের সৃষ্টি করা যাতে তারা দারিদ্র্য কাটিয়ে উঠতে পারে। কর্মসূচীর প্রথম পর্ব অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ দিন এবং দ্বিতীয় পর্ব মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪০ দিন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যমান মজুরির বাজার দরের আলোকে অদক্ষ প্রচলিত শ্রমিকদের ২০০ টাকা পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়ে থাকে এবং অতিদরিদ্র পরিবারের মধ্যে থেকে এ কর্মসূচীর জন্য কর্মী নিয়োগ করা হয়। দেশের ৬৪টি জেলা এই কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত। তবে অধিকতর দারিদ্র্যপীড়িত উপজেলাসমূহকে এই কর্মসূচীতে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তহবিল ও বীমা কর্মসূচী সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচীর আওতায় সরকারের সাড়ে নয় বছরে প্রায় ৪৫ হাজার ৩শ’ কোটি টাকার কৃষি সহায়তা এবং বর্গাচাষীদের জন্য কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে, বিনা জামানতে কৃষি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা যাতে কর্মহীনতা ও মজুরি হ্রাসজনিত বিপদ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে প্রতিবছর অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি-অর্থনীতিসহ বাংলাদেশের কৃষকরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব প্রশমনের লক্ষ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অনুদানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর কর্তৃক রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ ও নোয়াখালী জেলায় পরীক্ষামূলকভাবে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমা প্রকল্প চালু করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি নতুন প্রায়োগিক ধারণা। আবহাওয়া কেন্দ্র হতে প্রাপ্ত আবহাওয়াজনিত তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ বীমা পলিসি প্রস্তুত করা হয়েছে এবং প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই বীমা দাবি পরিশোধ করা হচ্ছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্য বীমার মাধ্যমে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি হ্রাস করা। ইতোমধ্যে অতিবৃষ্টি জনিত বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও অতিবৃষ্টি জনিত ঝুঁকি বিবেচনা করে আবহাওয়া সূচকভিত্তিক পরীক্ষামূলক শস্য বীমা পলিসির আওতায় উত্থাপিত বীমা দাবি ১৭,৫৪,৩১৪.০০ টাকা বীমা গ্রহীতা কৃষকদের সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের নিজস্ব তহবিল হতে পরিশোধ করা হয়েছে। গ্রামীণ মাতৃকেন্দ্র (আরএমপি) কর্মসূচী গ্রামীণ দরিদ্র মহিলারা সরকারের এই সেবা পাবেন। সমাজ সেবা অধিদফতর গ্রামে গ্রামে ৪০ জন করে মহিলা সদস্য নিয়ে কমিটি গঠন করে। এটাই পল্লীমাতৃকেন্দ্র। এই পল্লীমাতৃকেন্দ্রের সদস্যদের ক্ষুদ্রঋণ দেয়াসহ বিভিন্ন কর্মমুখী কাজের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এতে করে গ্রামীণ মহিলারা উপার্জন করতে পারে। তাদের কর্মসংস্থান হয়। এই অর্থ দিয়ে তারা পরিবারকে সাহায্য করতে পারে। সংসারে স্বচ্ছলতা আসে। পল্লী মাতৃকেন্দ্রের কোন সদস্যা সুদমুক্ত ঋণ পাওয়ার জন্য সমাজ সেবা অধিফতরে আবেদন করতে পারেন। আবেদন করলে তা যাচাই-বাছাই করে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার কর্তৃক অনুমোদন করা হলে নির্ধারিত স্থান, তারিখ ও সময়ে সুবিধাভোগীদের জানানোর মাধ্যমে ঋণের অর্থ নগদ বা চেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিতরণ করা হয়। গ্রামীণ মাতৃকেন্দ্র (আরএমপি) কর্মসূচির আওতায় গ্রামীণ দুস্থ মায়ের সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করা ছাড়া ও সুবিধাভোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার কর্মসূচী হতদরিদ্র মায়েদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে সরকার ‘মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম’ চালু করেছে। দেশের সকল মানুষের জন্য মানসম্মত ও সহজলভ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১৭-১৮ জাতীয় বাজেটে ৪৩ হাজার ৪ শত ৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদী স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মা ও শিশুর জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নত প্রজনন স্বাস্থ্য, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা, সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নতুন আবির্ভূত রোগ নিয়ন্ত্রণ, পুষ্টিমান সম্পন্ন নিরাপদ খাদ্য এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া দরিদ্র গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে পর্যায়ক্রমে নতুন নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক চালু এবং মাতৃ-স্বাস্থ্য ভাউচার কর্মসূচী সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহে গরিব, দুস্থ ও জটিল গর্ভবতী মহিলাদের জন্য মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার কর্মসূচী ৭৩টি উপজেলায় চালু হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×