ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

অস্থির ডলার বাজার ॥ আমদানি রফতানির আড়ালে পাচার!

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৮ মে ২০১৮

অস্থির ডলার বাজার ॥ আমদানি রফতানির আড়ালে পাচার!

রহিম শেখ ॥ প্রায় বছরখানেক ধরেই অস্থির ডলারের বাজার। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকায় টাকার বিপরীতে দাম বাড়ছে হু হু করে। সর্বশেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার ব্যাংকে নগদ ডলার সর্বোচ্চ ৮৬ টাকা ৩০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ২ টাকা। আর এক বছরে ৪ টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলারের দাম বাড়ছে পাঁচ কারণে। সাম্প্রতিক মাত্রাতিরিক্তি আমদানি ব্যয়, পাচার, রফতানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহের নিম্নগতিকে ডলার সঙ্কটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। ফলে আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে ডলারের বাজারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা। ব্যাংকটির মতে, কয়েকটি ব্যাংক পরিকল্পিতভাবে ডলারের বাজার অস্থির করে রেখেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অসাধু চক্র; যারা বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রফতানির আড়ালে ডলার পাচার করছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠী হুন্ডির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচার করায় স্থানীয় বাজারে ডলারের সঙ্কট চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের এই দিনে ব্যাংকভেদে নগদ ডলারের দাম ছিল ৮২ থেকে সর্বোচ্চ ৮৩ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। দুই সপ্তাহ আগেও ব্যাংকে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা ৪৫ পয়সা ধরে বিক্রি হয়। আর খোলা বাজারে ছিল ৮৫ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গত বছরের ৩০ এপ্রিল তারা প্রতিডলার বিক্রি করেছে ৮০ টাকা ২৩ পয়সা দরে। এখন করছে ৮৩ টাকা ১০ পয়সায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া সময়ের পর আমদানি বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে ৮৩ টাকা ৫০ পয়সা ছিল বেশ কিছুদিন। কয়েকদিনের ব্যবধানে কয়েকটি ব্যাংক এক্ষেত্রেও মূল্য বাড়িয়ে ৮৩ টাকা ৬৫ পয়সা করেছে। তবে গত বছর ছিল ৮২ থেকে ৮৩ টাকা ১০ পয়সা পর্যন্ত। এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের চাহিদার কারণেই দাম বাড়ছে। প্রচুর এলসির দেনা শোধ করতে হচ্ছে। তবে রফতানি ও রেমিটেন্স খাত থেকে সেই পরিমাণ আয় আসছে না। এ কারণেই ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর আগে গত বছরের শেষদিকে বিভিন্ন ব্যাংক তথ্য গোপন রাখছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বলে জানিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এখনও কয়েকটি ব্যাংক পরিকল্পিতভাবে রেট বাড়িয়ে দিচ্ছে; যা এর মধ্যে চিহ্নিতও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে তিনটি বিদেশী ও ১৭ দেশী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করে নোটিসও দিয়েছিল। সামান্য জরিমানা করে তাদের সতর্ক করা হয়েছিল। তাতেও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হয়নি। ওসব ব্যাংকের ভূমিকা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি পণ্যের দামও বাড়তে শুরু করেছে। এর প্রভাব মুক্ত নয় নিত্যপণ্যের বাজারও। ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণ খুঁজতে ও বাজার স্বাভাবিক করতে বাণিজ্যিক ব্যাংক অনুমোদিত ডিলার (এডি) ও মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এরপরও বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলসি খোলার ক্ষেত্রেও কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা প্রয়োজন। কে কোন্ পণ্য আমদানি করছেন। এলসি খোলার সঙ্গে আমদানি পণ্যের সামঞ্জস্য আছে কিনা এসব বিষয়ে অধিক যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, সম্প্রতি দেশের পণ্য ও সেবা উভয়ের ক্ষেত্রেই বেড়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) মোট বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩২০ কোটি ২০ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পণ্য ও সেবা খাতে প্রচুর পরিমাণ আমদানি ঋণের দায় পরিশোধ হচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে এক ধরনের টান সৃষ্টি হয়েছে ডলারের বাজারে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য আমদানিতে ৫ হাজার ৫৯৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩ হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২৮ কোটি ডলার বা ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকার বেশি। এর বেশিরভাগই আমদানি হচ্ছে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী যন্ত্রপাতি। অথচ এ খাতে আমদানি বাড়লেও শিল্প স্থাপন, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে না। এ ছাড়া এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল এবার ১৪০ কোটি ডলারে উঠেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মেয়াদে আকুর বিল ১৫৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারে উঠেছিল। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ; এই ৯ দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মেয়াদে ১১৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার আকুর বিল পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদে শোধ করা হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। নবেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদে আকুর বিল ছিল ১৩৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এদিকে আমদানিতে ডলারের চাহিদা মেটানো হতো রফতানি আয় ও রেমিটেন্স দিয়ে। আগে আমদানির পরিমাণ কম এবং রফতানি আয় ও রেমিটেন্স প্রবাহ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলোয় বাড়তি ডলার থাকত। ওগুলো তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে বিক্রি করে দিত ব্যাংকগুলো। ফলে বাড়ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে রফতানি আয় ও রেমিটেন্স বাবদ যা আসছে তা দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে ডলার দিতে হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১০ মাসে (২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ৩ মে পর্যন্ত) বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ১৯৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার কিনেছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বছরখানেক ধরেই ডলারের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর সঠিক কারণ খুঁজতে হবে। এতে কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগও উঠেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অন্য ব্যাংকারদের সচেতন হতে হবে। যদি কারও বিরুদ্ধে কারসাজির তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ডলারের দাম নিয়ে কেউ কারসাজি করেছে বা করছে এটা যদি চিহ্নিত হয়ে থাকে, তাহলে সবার আগে সে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। ব্যাংকগুলো যে রেটে ডলার বিক্রি করে আর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যে রেট সরবরাহ করে তা আরও কঠোরভাবে তদারকি করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। ডলারের দাম বাড়লে সবার আগে এর প্রভাব পড়বে আমদানি খাতে। যা সব ধরনের আমদানি পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিতে পারে বলে জানান তিনি। এদিকে চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সাধারণত নির্বাচনী বছরে অর্থপাচার বেড়ে যায় ব্যাপক হারে। সেই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যায়। অতীতের বেশ কয়েকটি নির্বাচনী বছরের রিজার্ভের স্থিতি বিশ্লেষণ করে এমনটাই দেখা গেছে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্সির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৭৫১ কোটি ৫০ লাখ ডলার অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে। ওই ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় ২০১৩ সালে নির্বাচনের বছরটিতে। সে বছর ১ হাজার ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার পাচার হয়। এর আগে সবচেয়ে বেশি পাচার হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকালীন বছর ২০০৮ সালে। ওই বছর পাচারের পরিমাণ ছিল ৯৭২ কোটি ১০ লাখ ডলার। সূত্র জানায়, কয়েকটি উপায়ে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার হয়। এর মধ্যে আমদানি-রফতানি, ক্যাশ ও হুন্ডিতেই সবচেয়ে বেশি। যেসব পণ্য আমদানিতে কম শুল্ক দিতে হয়, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল এবং খুচরা যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয় বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। সরকারী প্রণোদনা পেতে রফতানি পণ্যেও বেশি মূল্য দেখানো হয়। অথচ সেই আয় দেশে আসছে না। অন্যদিকে ভুয়া রফতানি আয় দেখিয়ে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তার অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে অর্থপাচার, যার ৮০ শতাংশই হচ্ছে ব্যাংকের মাধ্যমে। আমদানি-রফতানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং; আমদানি-রফতানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং; পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা, একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে।
×