ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৯ মে ২০১৮

ইসলাম প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান

(গতকালের পর) হজ পালনের জন্য সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোন সরকারী অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারী তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন এবং হজ ভ্রমণ কর রহিত করেন। ফলে হজ পালনকারীদের আর্থিক সাশ্রয় হয়। বঙ্গবন্ধু শাহাদাত লাভের পর যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা কথায় কথায় নিজেদের ইসলামের সেবক দাবি করলেও তাদের আমলে সরকারী অনুদান বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। যা এদেশের অনেকেই হয়ত জানেন না। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন ইসলামী আকিদাভিত্তিক জীবন গঠন ও দ্বীনিশিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করেন। পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্ত শাসিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডকে স্বায়ত্ত শাসন প্রদান করে এর নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড।’ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধ প্রসারের এক মাইলফলক। জাগতিক শিক্ষার সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার আধুনিকীকরণের পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চতর শিক্ষার দ্বার উন্মুক্তকরণ এবং মাদ্রাসা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সরকারী চাকরির নিশ্চয়তা ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করেছিলেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ আলী আহসান তার ‘বঙ্গবন্ধু যেমন দেখেছি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মাদ্রাসার জন্য সরকারী অনুদান বন্ধের একটি প্রস্তাব সংবলিত নথি বঙ্গবন্ধুর কাছে উপস্থাপন করা হলে বঙ্গবন্ধু ফাইলে লিখেন যে, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য যে বরাদ্দ এতদিন ছিল, সেটাই থাকবে। তবে ভবিষ্যতে এ বরাদ্দ আরও বাড়ানো যায় কিনা এবং কতটা বাড়ানো যায়, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’ বেতার ও টিভিতে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত প্রচার বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে তারই নিদের্শে সর্বপ্রথম বেতার ও টেলিভিশনে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পবিত্র কুরআন ও তার তাফসির এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচার করার সুব্যবস্থা করা হয়। ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ), শব-ই কদর, শব-ই বরাত উপলক্ষে সরকারী ছুটি ঘোষণা ধর্মীয় দিবসসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে সরকারী ছুটি ঘোষণা করেন এবং উল্লেখিত দিবসসমূহের পবিত্রতা রক্ষার্থে সিনেমা হল বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। মদ, জুয়া ও ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ ইসলামের নাম নিয়ে পাকিস্তানীরা দেশ পরিচালনা করলে ও তাদের সময়ে মদ, জুয়া, নিষিদ্ধ ছিল না। অথচ বঙ্গবন্ধু সরকার আইন করে মদ, জুয়া ও ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোড়দৌড়ের নামে জুয়া, লটারি এবং গেট-এ-ওয়ার্ড প্রভৃতি ইসলামবিরোধী অনুষ্ঠানাদিতে বিদেশীদের জন্য মদ পরিবেশন বন্ধ করে দেন। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য ‘আমাদের দেশে পাকিস্তান আমলে ইসলামবিরোধী বহু কাজ হয়েছে। রেসের নামে জুয়া খেলা রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ছিল। আমি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দিয়েছি, পুলিশকে তৎপর হতে বলেছি, শহরের আনাচে কানাচে জুয়াড়িদের আড্ডা ভেঙ্গে দিয়েছি। আমি ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলি, ধর্ম নিরেপেক্ষতা ধর্মবিরোধিতা নয়। আমি মুসলমান। আমি ইসলামকে ভালবাসি। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন, দেখবেন এদেশে ইসলামবিরোধী কর্মকা- কখনই হবে না (সৈয়দ আলী আহসান, বঙ্গবন্ধু যে রকম দেখেছি, পৃ;১৬)। বিশ্ব এজতেমার জন্য টঙ্গিতে সরকারী জায়গা বরাদ্দ দান বিশ্ব এজতেমা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধা করার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবে তুরাগ নদীর তীরবর্তী জায়গাটি প্রদান করেন। সে হতে অদ্যাবধি তাবলিগ জামায়াত ওই স্থানে বিশ্ব এজতেমা করে আসছে। কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য জমি বরাদ্দ তাবলিগ জামায়াতের মারকায বা কেন্দ্র নামে পরিচিত কাকরাইল মসজিদের সম্প্রসারণ কল্পে রমনা পার্কের অনেকখানি জায়গার প্রয়োজন যখন দেখা দেয়, তখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় কাকরাইল মসজিদকে দেয়ার যাবতীয় ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে করে দেন। রাশিয়াতে প্রথম তাবলিগ জামায়াত প্রেরণের ব্যবস্থা রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। সে দেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেতনা। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদেশের নেতৃবৃন্দের একটি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রথম তাবলিগ জামায়াত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন ও সাহায্য ১৯৭৩ সালে আরব-ইসলারইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আরব বিশ্বের পক্ষ সমর্থন করেন এবং এই যুদ্ধে বাংলাদেশ তার সীমিত সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ অবদান রাখার চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে ১ লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী প্রেরণ করা হয়। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) অধিবেশনে যোগদান করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করার মধ্যদিয়েই বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মাঝে বাংলাদেশের স্থান করে নেন। ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে যে বক্তব্য তুলে ধরেন এতে আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা সমুন্নত হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সুদঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অবদান ১. আল-কুরআনের ডিজিটালাইজেশন ২. ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ ৩. দেশের ৩১টি কামিল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালুকরণ ৪. যোগ্য আলেমদের ফতোয়া প্রদানে মহামান্য আদালতের ঐতিহাসিক রায় ৫.জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সৌন্দর্যবর্ধন ও সম্প্রসারণ ৬. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সুউচ্চ মিনার নির্মাণ ৭. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ সাহান সম্প্রসারণ ৮. সৌন্দর্য বর্ধন ও পূর্ব সাহানের ছাদ নির্মাণ ৯.জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মহিলাদের নামায কক্ষ সম্প্রসারণ ১০.জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সাহানের স্থান সম্প্রসারণ ১১. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম কমপ্লেক্স ১২. ইসলামিক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরি ভবন নির্মাণ ১৩. বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও রাজকীয় সৌদি আরব সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর ১৪. হজ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুুক্তির ব্যবহার ১৫. জেদ্দা হজ টার্মিনালে ‘বাংলাদেশ প্লাজা’ স্থাপন ১৬. আশকোনা হজক্যাম্পের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ১৭. রেকর্ড সংখ্যক হজযাত্রী প্রেরণ ১৮. হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি সরকারের স্বীকৃতি ১৯. মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে আলেম-ওলামাদের কর্মসংস্থান ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ২০. শিশু ও গণশিক্ষা এবং কুরআন শিক্ষা কার্যক্রমে মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ ২১. জাতীয় শিক্ষানীতিতে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকরণ ২২. কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সনদের সরকারী স্বীকৃতির জন্য আলাদা কমিশন গঠন ২৩. ১০০০টি বেসরকারী মাদ্রাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণ ২৪. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নাধীন ২৫. ইমাম প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ২৬. ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন ২৭. ইসলামী প্রকাশনা প্রকল্প বাস্তবায়ন ২৮. ইসলামিক মিশন কেন্দ্রের মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা প্রদানের ব্যবস্থা ২৯. মসজিদ পাঠাগার স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন। ৩০. ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ডিজিটালে রূপান্তর ৩১. জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম শীর্ষক কর্মসূচী বাস্তবায়ন ৩২. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্বনেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশের আলেম-ওলামাদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা ৩৩. মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান ৩৪. চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আন্দরকিলাহ শাহী জামে মসজিদের উন্নয়নে বিশাল অঙ্কের বাজেট অনুমোদন ৩৫. চট্টগ্রাম জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদ কমপ্লেক্স ফাউন্ডেশনের অনুকূলে ন্যস্তকরণ ৩৬. পবিত্র রমজানে মসজিদে মসজিদে ব্যাপক কুরআন শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা ৩৭. সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ ৩৮. আন্তর্জাতিক হিফজ, ক্বিরাত ও তাফসির প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সাফল্য ৩৯. জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদিত প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন মডেলে ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন ৪০. ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণের ঘোষণা ও বাস্তবায়ন ৪১. প্রতি জেলা ও উপজেলা সদরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের আদলে মসজিদ নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উপজেলা পর্যায়ে একটি করে মসজিদ সরকারীকরণ ৪২. একটি গ্রাম একটি মক্তব চালু করার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুগান্তকারী অবদানের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামল ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামের খেদমতে যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এবং রেখে চলছেন, গোটা পৃথিবীতে তার দৃষ্টান্ত বিরল। তবুও ইসলামের লেবাসধারী একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে ইসলামবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। এসব মতলববাজ নিন্দুকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে ধর্মপ্রায় মানুষকে। (সমাপ্ত) লেখক : গবেষক
×