ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ও সংবাদ সম্মেলনে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল চীন রাশিয়া ভারত ও জাপানের জোরাল ভূমিকা চান প্রধানমন্ত্রী

সমাধান চায় চীন-রাশিয়া ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সম্পর্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিরা

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১ মে ২০১৮

সমাধান চায় চীন-রাশিয়া ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সম্পর্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ প্রতিনিধিরা

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কটের অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। চীন-রাশিয়াও এই সঙ্কটের সমাধান চেয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাবশালী এই দুইটি দেশ রোহিঙ্গা সমস্যার সহজ বা তাৎক্ষণিক কোন সমাধান দেখতে পাচ্ছে না। সোমবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে। এদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপানের কাছ থেকে বড় ভূমিকা আশা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখে সোমবার বাংলাদেশ ছাড়ার আগে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে তাদের প্রতিক্রিয়া ও মতামত তুলে ধরে। প্রতিনিধি দলের পক্ষে জাতিসংঘে নিযুক্ত কুয়েতের স্থায়ী প্রতিনিধি মনসুর আয়াদ আল-ওতাইবি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, যে বার্তা আমরা মিয়ানমার, রোহিঙ্গা শরণার্থী আর পুরো বিশ্বকে দিতে চাই, তা হলো এই সঙ্কটের অবসান ঘটাতে এবং সমাধানের একটি পথ খুঁজে বের করতে আমরা বদ্ধপরিকর। প্রতিনিধি দলের নেতা নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা সুআদ্রা এবং যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি ক্যারিন এলিজাবেথ পিয়ার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। কুয়েতের প্রতিনিধি মনসুর আয়াদ আল-ওতাইবি এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেন, চীন বা রাশিয়ার দিক থেকে কোন বাধা তিনি দেখেননি। তারা নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য এবং তারাও আমাদের সঙ্গে আছে। তাদের বক্তব্য গতকাল আপনারা শুনেছেন। আজ তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সাক্ষাত করেছেন এবং এই সঙ্কটের সমাধানে পৌঁছানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। অবশ্য তারা যে এ সমস্যার সহজ বা তাৎক্ষণিক কোন সমাধান দেখতে পাচ্ছেন না, সে কথাও বলেন মনসুর আয়াদ আল-ওতাইবি। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এই সমস্যার সমাধানে সব পক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতি ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পেরুর স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত গুস্তাভো মেজা সুআদ্রা বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায় তার জন্য বাংলাদেশে সরেজমিনে অভিজ্ঞতা নিতে এসেছি। এখান থেকে একই বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা নিতে আমরা মিয়ানমার যাব। সেখান থেকে ফিরে গিয়ে এ সমস্যার সমাধানে সম্ভাব্য সেরা উপায় খুঁজে বের করব। তিনি আরও বলেন, এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল নয়। অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারকে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে। যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি ক্যারিন এলিজাবেথ পিয়ার বলেন, মিয়ানমারে যে হত্যাকা- ও নির্যাতন ঘটেছে তার বিচার করতে হলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করতে হবে। জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পর্ষদ হিসেবে বিবেচিত নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ দেশের প্রতিনিধিসহ ৪০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রবিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখেন। সোমবার তারা রওনা হন মিয়ানমারের নেপিডোর উদ্দেশে। গত বছর আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হয়ার পর এই প্রথম জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কোন প্রতিনিধি দলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করল। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ব্যাপক হত্যা নির্যাতনের মুখে গত আট মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করে আসছে জাতিগত নির্মূল অভিযান হিসেবে। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশে এলেও এই সঙ্কটে জাতিসংঘের এই পর্ষদ কীভাবে সম্পৃক্ত হবে তা নিয়ে মিয়ানমারের দুই মিত্র দেশ রাশিয়া ও চীনের ভিন্নমত ছিল। অন্যদিকে লাখ লাখ রোহিঙ্গার ভার বহন করে আসা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই সঙ্কটের দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে তাগিদ দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা পরিষদকে। এই সঙ্কট সময়মতো সামাল দেয়া না হলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলেও সতর্ক করে আসছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপানের কাছ থেকে বড় ভূমিকা প্রত্যাশা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার গণভবনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সামনে এই প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পর্ষদ হিসেবে বিবেচিত নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ দেশের প্রতিনিধিসহ ৪০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রবিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখে সোমবার বিদায় নেয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তাদের এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে রয়েছেন নিরাপত্তা পরিষদের চলতি মাসের সভাপতি গুস্তাভো মেজা সুআদ্রা। রোহিঙ্গা সঙ্কটের গভীরতা বুঝতে বাংলাদেশ থেকে সোমবার তারা মিয়ানমারে যাচ্ছেন। গণভবনের বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের বলেছেন, চীন, রাশিয়া, ভারত ও জাপান এই সঙ্কট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই আমরা প্রত্যাশা করি। এ সমস্যার সমাধান নিয়ে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওসসহ মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথাও বৈঠকে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। প্রেস সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর জোরালো চাপ সৃষ্টির জন্যও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমার যে চুক্তি করেছে সে অনুযায়ী মিয়ানমারের কাজ করা উচিত বলেও বৈঠকে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহযোহিতা এবং তাদের কাছে জরুরী সহায়তা পৌঁছে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে ভূমিকা রেখেছে বৈঠকে তার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের উপ স্থায়ী প্রতিনিধি কেলি কারি বৈঠকে বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার মাধ্যমে মানবিক দিক থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য নতুন একটি নজির বেঁধে দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। চীনের প্রতিনিধি উ হাইতাও বলেন, তার দেশ এই সঙ্কটের সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে। রাশিয়ার প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানেও বাংলাদেশকে সমর্থন অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন। প্রেস সচিব জানান, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ সংঘাত চায় না এবং এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর এবং মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের কথা তিনি বৈঠকে তুলে ধরেন এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হওয়ার ওপর জোর দেন। নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার চাপে কক্সবাজারে স্থানীয়রা ভোগান্তিতে পড়েছে। পরিবেশ ও বনভূমির ক্ষতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বর্ষায় আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বাড়ার আশঙ্কার কথা নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরেন এবং ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা তাদের বলেন। বৈঠকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক উপস্থিত ছিলেন। শনিবার বিকেলে কক্সবাজারে পৌঁছেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রতিনিধি দল। সোমবার সকালে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ঢাকা থেকে মিয়ানমার গেছেন। অবশ্য নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলকে মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল মিয়ানমার। প্রতিনিধি দলকে প্রথমে রাখাইন এলাকা পরিদর্শনের অনুমতি দিতে চায়নি মিয়ানমার। তবে মিয়ানমার চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তাদের রাখাইনে যেতে দিতে রাজি হয়েছে। মিয়ানমারে দু’দিন সফর শেষে প্রতিনিধি দল নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা দেবে।
×