ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দুই কোরিয়ার সম্প্রীতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৩০ এপ্রিল ২০১৮

দুই কোরিয়ার সম্প্রীতি

সাড়ে ছয় দশকের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্প্রীতির সূচনা ঘটায় বিশ্ববাসী চমকিত হলেও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। যুদ্ধবিরোধী শান্তিকামী বিশ্ববাসীর জন্য এই সুখবার্তা বলে দিচ্ছে যে, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ এখনও জাগ্রত রয়েছে এবং প্রকৃত বিচারে শেষ পর্যন্ত মানুষ ধ্বংস চায় না। কবি তো বলেই গেছেন ‘মিলনই মৌলিক’। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার দুই নেতার কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধ অবসানের ঘোষণা প্রদান বিশ্বনেতৃবৃন্দকে আশ্বস্ত করেছে। তাদের প্রদত্ত প্রতিক্রিয়া থেকেই অনুমান করা যায় বিশ্বের বড় বড় দেশ সাম্প্রতিককালে দুই কোরিয়ার যুদ্ধের সাজ সাজ রবে কতখানি উৎকণ্ঠিত ছিলেন। একদিকে উত্তর কোরিয়ার নেতা পরমাণু অস্ত্রের অহঙ্কারে বিশ্বের সবচেয়ে পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে একহাত দেখে নেয়ার জন্য হুমকি দিয়ে আসছিলেন, অপরদিকে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক শক্তির বিস্তার ঘটাতে শুরু করেন। সব মিলিয়ে যুদ্ধ লেগে যায় যায় অবস্থা। যা হোক, শেষ পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানো গেছে। নেতাদের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এই মহাঘটনাকে অর্থাৎ দুই কোরিয়ার নেতার ফলপ্রসূ বৈঠকের বিষয়টিকে বিশ্ববাসীর জন্য অভাবনীয় সুখবর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছেন, দুই কোরীয় নেতা অস্থিতিশীল বিশ্বকে স্থিতিশীল করার পথ দেখালেন। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার আনন্দ না লুকিয়ে খোলাখুলি বলেছেন, এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র ভীষণ উচ্ছ্বসিত। ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ থামাতে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল তা এ বছরই শান্তি চুক্তিতে বদলে দিতে দুই নেতা সম্মত হয়েছেন। নেতাদ্বয় আনুষ্ঠানিকভাবেও বলেন, কোরীয় উপদ্বীপে আর কোন যুদ্ধ হবে না। যৌথ ঘোষণায় পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে, ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত অখ- কোরীয় উপদ্বীপ ছিল জাপান নিয়ন্ত্রিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর কোরীয় উপদ্বীপ ত্যাগ করে জাপান। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন কোরীয় উপদ্বীপে কর্তৃত্ব দখলে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। নিজ ভূখণ্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় কোরীয় উপদ্বীপের উত্তর ভূখ-ে প্রভাববলয় তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, অন্যদিকে দক্ষিণ অংশের কর্তৃত্ব চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র একদিকে চেয়েছিল সম্পূর্ণ কোরিয়া তাদের প্রভাববলয়ে চলে আসুক। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চায় তাদের ভূখণ্ডের কাছাকাছি উত্তর কোরিয়া অন্তত তাদের প্রভাববলয় হতে যেন বের হতে না পারে। ১৯৫০ থেতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে কোরীয় উপদ্বীপে। মাত্র তিন বছরের যুদ্ধে একটানা বোমাবর্ষণের ফলে উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ প্রাণ হারান। দুই কোরিয়ার ভেতর সম্প্রীতির সুবাতাস বয়ে যাওয়ার পর সঙ্গত কারণেই সামনে চলে আসবে এশিয়ারই দক্ষিণ অংশের দুটি দেশের ভেতর দশকের পর দশক ধরে চলে আসা বৈরিতার বিষয়টি। ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের ভেতর রেষারেষি এবং পরমাণু অস্ত্রশক্তিতে পরস্পরকে টেক্কা দেয়ার বিষয়টির অবসান না ঘটলে সমগ্র এশিয়াই যে হুমকির মধ্যে থাকবে তা বলা বাহুল্য। এখন সময় এসেছে সুসম্পর্কের সুবাতাস রচনা করার। এর ফলে যে শুধু দুটি দেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই রক্ষা পাবে তা নয়, এর ভেতর দিয়ে বিশ্বের বড় দেশগুলোর ভেতরেও অস্বস্তি ও পারস্পরিক অনাস্থার মানসিকতার অবসান ঘটবে। বলাবাহুল্য, অর্থনৈতিকভাবেও বলীয়ন হয়ে উঠবে বিবদমান দুটি দেশ ভারত-পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ। দুই কোরিয়ায় শান্তি ফেরার পর দক্ষিণ এশিয়ায়ও বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে বন্ধুতার পতাকা উড়ুক- সেটাই প্রত্যাশা।
×