ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

নদী বাঁচাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

নদী বাঁচাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

নদীমাতৃক বাংলাদেশকে অনেকে আগের মতো আর সেভাবে সম্বোধন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করছে না বিভিন্ন কারণে, যার মধ্যে রয়েছে জনসৃষ্ট তথা প্রাকৃতিক কারণে নদ-নদীগুলোর অকাল মৃত্যু, যা আমাদের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি। অথচ এক সময় শুধু প্রাকৃতিক নয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবন-জীবিকা, নৌযান চলাচল তথা পরিবহনে খাল-বিল, নদী-নালার এক অপূর্ব ভূমিকা ছিল। নদী-নালাগুলো মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকত দেশজুড়ে, যেমন পরম করুণাময়ী মায়ের মতো। বাংলাদেশের নদ-নদী সাহিত্যে, গানে, নাটকে ও জীবন-জীবিকায় অসামান্য অবদান রেখেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণবিলাসী মনের পরিচয়ে বারবার উঠে এসেছে তার সাহিত্যে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুঠিবাড়ী থাকা সত্ত্বেও তিনি পদ্মায় বজরায় রাত কাটাতেন, যার ফসল ‘নৌকাডুবি’র মতো উপন্যাসসহ ‘সোনার তরী’ কবিতা। অতঃপর রবীন্দ্রপরবর্তী বলয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী গান ‘পদ্মার ঢেউরে’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ‘গোলাম মোস্তফার’ ‘পদ্মা নদী’, ড. নীহার রঞ্জন গুপ্তের ‘নদীর নামটির মধুমতি’, ভৌরব প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রিক্তা নদীর বাঁধ’ আমাদের সাহিত্য অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। নদ-নদী প্রকৃতির দান; কিন্তু আমাদের নদীগুলো যেমন চিত্রা, মধুমতি, নবগঙ্গা, আন্ধারমানিক, পুনর্ভবা, ডাকাতিয়া, বংশাই, সুবর্ণখালী, পেয়াই, আইরলক্ষ্যা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, নারদ, গড়াই, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, মাথাভাঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা, যমুনা, পিয়াইন, বাঙ্গালী, মিনাই, কালীগঙ্গা, ময়নাকাটা ইত্যাদি ঐতিহ্যের বাহক। এসব ঐতিহ্যবাহী নদী এখন বাংলাদেশের কেবল গবেষক, কবি কিংবা সাহিত্যিকের সৃষ্টিশীলতার উপাদান। এগুলো এখন এক শ্রেণীর মানুষের অর্থবিত্তের অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষার কাছে হার মেনে বসছে, যার প্রাদুর্ভাব নদী দখল, নদী শোষণ ইত্যাদি, যা বেশিরভাগ নদীর মৃত্যুর কারণ। দৈনিক পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্যান্য পত্রিকা দেশের নদ-নদীগুলোর দুর্দশার ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছে এবং এ সকল প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে নদীবহুল বাংলাদেশ এখন নদীহীন দেশে পরিণত হচ্ছে। এতে বদলে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য তথা মানুষের জীবন-জীবিকা। এখন অনেক নদী হয়েছে খেলার মাঠ, বসতবাড়ি, চাষের কৃষি জমি কিংবা শিল্প-কারখানা স্থাপন, আবাসন প্রকল্প, দলীয় স্থাপনা, যা সবই অবৈধ। এমন সময় এসে গেছে যে, দেশের এ নদীগুলোতে সহজেই বাঁধ দিয়ে চলছে মাছের চাষ, বনায়ন, গরু ও মুরগির খামার স্থাপন। এতে করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কিংবা উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নদী অর্থনীতি কিংবা হাওড় অর্থনীতি এখন বিপাকে পড়েছে। দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী সাতটি জেলার জনপদ সম্পূর্ণভাবে সমুদ্র সংযোগ নদীর ওপর নির্ভরশীল, যার মধ্যে আছে নৌকা, নৌযানভিত্তিক ব্যবসা, মৎস্যজীবী শ্রেণীর মাছের আহরণ ইত্যাদি। আবার সমতলে নদী হারিয়ে যাওয়া মানেই দু’পাড়ের মানুষের সভ্যতা বিপন্ন হওয়া। তার মধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতির কৃষি ব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি বিপন্ন। অথচ অনেকেই বলছে নদী হচ্ছে গ্রামবাংলার প্রাণ, যাকে ঘিরে হয় মানুষের জীবনচক্র, হাট-বাজার, কল-কারখানা, নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান, শহর, সভ্যতা। তাই নদী হলো জীবন কিংবা নদী হলো মরণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ৫৪টি নদী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং এ সকল অভিন্ন নদীর ওপর উজানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য কৃষিতে আর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ পাম্পও কাজ করছে না। এখন ষড়ঋতুর দেশ বলতে যা বোঝানো হয় তারও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি নেই, বসন্তের আগেই বসন্তের আগমন, শীতের ব্যাপকতা থাকলেও স্থায়িত্ব কমে গেছে, বর্ষায় নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় অল্প বৃষ্টিতেই বন্যা ইত্যাদি এখন দেশের মানুষের নিত্যদিনের সঙ্গী। তথ্যসূত্র বলছে, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীসমূহের প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার তলদেশ এরই মধ্যে ভরাট হয়ে গেছে। রাজশাহী জেলার মানচিত্র থেকে সাতটি নদী এরই মধ্যে হারিয়ে গেছে আর তেরোটি নদীর মধ্যে এগারোটি পানিশূন্য হয়ে গেছে। এই ধরনের একই চিত্র প্রায় প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে। খোদ রাজধানী ঢাকার বুড়িগঙ্গার দূষণ ও দখল নিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন এবং মিডিয়া প্রায়শ সংবাদ প্রচার করে চলছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হয়। বিষয়টি প্রশাসন তথা ভূমি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার হলেও রাজনীতির প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়ে উঠছে না। কারণ, এ কথা সত্য যে, বিত্তশালী অনেক ব্যক্তি নদী, বন, জলাশয় কিংবা পাহাড় ব্যবহার করে তাদের প্রতিপত্তিকে সমাজে আরও বেশি প্রতিফলিত করতে দখল মহোৎসবে লিপ্ত রয়েছে। অর্থাৎ এ সব কাজ ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়েছে ক্ষমতার বলয়ের অন্তরালে। আর যাদের এগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব রয়েছে তাদের বেশিরভাগ সময়ই নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়, যা সার্বিক অর্থে দুর্ভাগ্যজনক তথা লজ্জাকর। এ ধরনের একটা পরিস্থিতিতে ‘মরছে নদী, ধুঁকছে মানুষ’ নামে স্লোগান প্রায়শই শোনা যায় পরিবেশবাদীদের কাছ থেকে। কিন্তু তাদের শক্তি কতটুকু আছে এক বিশাল দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়তে? প্রাকৃতিক কারণে নদী বা শাখা নদীগুলো তার নাব্য হারিয়েছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের পানি কিংবা বর্জ্য জমানোর কারণে এবং আমাদের দেশের মানুষ এখন প্রকৃতির খুব একটা শক্তিশালী প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে কি নদী দখলে বা বন দখলে। যার ফলে প্রাণিকুল বিপন্ন প্রায়, যা আমরা চ্যানেল আই-এর ‘প্রকৃতি ও জীবন’ অনুষ্ঠান থেকে জানতে পারি। কিন্তু প্রকৃতি নিধন হতো না যদি সরকারের রাজনৈতিক ও সামাজিক সদিচ্ছা এবং দায়িত্ব থাকত। গবেষকরা বলছেন, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনায় যে অনিয়ম-অনাচার চলছে তা যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা হয় তবে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে প্রকৃতি বির্পযয় অনিবার্য। এমন একটা সময়ে সেগুলো ঘটছে যখন দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে পা রেখেছে এবং একে টেকসই বেগবান রাখতেই এসব বিষয়ে সরকারী নিয়ন্ত্রণ জরুরী। প্রথমত : ছোট বা বড়, শাখা কিংবা প্রশাখা যে কোন ধরনের নদীকেই তার নাব্য ফেরাতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মূল নদীর সঙ্গে শাখা নদীগুলোর সংযোগমুখ প্রশস্ত এবং নৌযান চলাচলের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকা- বেগবান করতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, কিছুসংখ্যক অসাধু প্রকৌশলী, ঠিকাদারের কারসাজিতে সরকারী অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয় না কিংবা বরাদ্দের টাকার অর্ধেকও যদি ব্যয় হতো তাহলেও অনেক কাজ সম্পন্ন হতো। এসব নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত : নদ-নদীগুলো দূষণসহ মৃত হওয়ার প্রধান কারণ শিল্পের বর্জ্য নদীতে প্রেরণ, যা আইনবিরোধী এবং একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শিল্প-কারখানার মালিকরা তা কোনভাবেই পালন করছে না কেবল পরিবেশ দফতরের উদাসীনতার কারণে। অথচ শিল্প-কারখানার অনুমোদনের সময় পরিবেশের দিকটি বিবেচনায় রেখেই প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়, যা পরবর্তীতে তা আর মানা হয় না। আবার মানুষের কি এতটুকু বিবেচনা নেই যে, তাদের শিল্পের বর্জ্যগুলো নদীতে ফেলে এত বড় ক্ষতি করছে? এ সকল নদীর পানির ব্যবহারে জীবন-জীবিকা ও প্রাণিজ বসতিতে স্বাস্থ্য সঙ্কট সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত : বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় একটি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউ রয়েছে সত্যি; কিন্তু তাদের গবেষণার ফলাফল নদ-নদী রক্ষার কি কাজে লাগছে তার কোন আলামত পাওয়া দুষ্কর। কারণ, বিষয়গুলো এতই টেকনিক্যাল যে, সাধারণ কেন অনেক বিশেষজ্ঞই বুঝতে বা জানতে অপারগ। তাই প্রশাসনিক সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা উদ্যোগী মন্ত্রণালয় যেমন পানিসম্পদ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয় তাদের গবেষণার ফলাফলের সফল প্রয়োগ করে দেশের নদীগুলোকে কিভাবে রক্ষা করবে তা ভাবনার সময় এসেছে। চতুর্থত : নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাধার ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদ, যা দেশজুড়েই ছড়িয়ে আছে এবং সেগুলোর গুণগত মান ধরে রাখার দায়িত্ব জনগণের, যা থেকে সমাজ উপকৃত হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, সমাজ কাঠামোতে নিঃস্বার্থ লোক একেবারেই কমে গেছে এবং যারা আছে তারা ভোগদখল নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে, দেশের রাজনীতি কি সমাজ উন্নয়নের জন্য নাকি ব্যক্তি উন্নয়নের জন্য? পঞ্চমত : নদীসহ সব প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় জনগণের সম্পৃক্তকরণ কিংবা অংশীদারিত্ব যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে জনগণই এগুলোর পাহারাদার (ডধঃপয উড়ম) হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু সেই ধরনের উদ্যোগ সৃষ্টিতে জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যা ভুলে গেলে চলবে না। ষষ্ঠত : যারা অবৈধভাবে নদী থেকে মাটি কিংবা বালু উত্তোলন করছে কিংবা লিজ গ্রহণ তথা জলমহাল দখল করে বেড়াচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্যের বিনিময়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু তাই নয়, নদী রক্ষা করতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। নদী রক্ষায় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে নদ-নদী দখলমুক্ত করে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ সৃষ্টি করতে হবে। সপ্তমত : সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতে নদীভাঙ্গনরোধ ও ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ রয়েছে; কিন্তু নদ-নদী ও খাল-বিল উদ্ধারের ভিশন অনুপস্থিত। ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিশন যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে ঘোষণা করেন তখন অনেকেই তা বুঝতে পারেননি; কিন্তু আজ তা বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখন নদী ব্যবস্থাকে চালু রাখতে হলে প্রতিবেশী ভারত থেকে আসা ৫৪টি নদীতে পানির যথাযথ ব্যবস্থাপনা চালু রাখতে হবে। এটা নির্ভর করে নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ধরনের ওপর। তাই বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ব্যাপক ড্রেজিংসহ নদীভাঙ্গন রোধ, নদীর তীর রক্ষা ও নদীগর্ভ থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করতে হবে। তবে কাজটি এত সহজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে সংশ্লিষ্ট সকল দফতরের সমন্বিত প্রয়াস। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
×