ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

প্রকাশিত: ০৪:১১, ৮ এপ্রিল ২০১৮

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

(গত ২৮ মার্চের পর) চাষ হচ্ছে মাত্র ৫০৪৭০ হেক্টর জমিতে চা বাগানের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণ ১১৪০১৪ হেক্টর। কিন্তু বাস্তবে চাষ হচ্ছে মাত্র ৫০৪৭০ হেক্টর। এরমধ্যে আছে রুগ্ন চা-বাগান, যে সকল চা বাগানে চা চাষের অবস্থা খুবই নাজুক, চা চাষকৃত জমিতে নেই ছায়াবৃক্ষ। সঠিক সময় চা পাতা চয়ন, আগাছা ছাটাই করা হয় না, ড্রেনেস ব্যবস্থা সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করাসহ নানা কারণে চা গাছে ঠিকমত পাতা গজায় না ফলে টার্গেট অনুযায়ী উৎপাদন হয় না। বর্তমানে চাষকৃত জমিতে ৬ কোটি কেজি পর্যন্ত চা উৎপাদিত হচ্ছেÑ যেখানে অনায়াসে ৩০ কোটি কেজি চা উৎপাদন সম্ভব। দেশে প্রতি বছর চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে সাড়ে তিন শতাংশ হারে। আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশীয় বাজারে চায়ের মূল্য বেশি হওয়ায় প্রতি বছর বিশ্ববাজারে চা পাঠাতেও নিরুৎসাহবোধ করছে দেশ। গত বছর দেশে উৎপাদিত ৬ কোটি কেজি চায়ের মধ্যে দেশে ব্যবহৃত হয়েছে সাড়ে ৫ কোটি কেজি। ২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকার চা রপ্তানী হয়, ২০০৬-২০০৭ অর্থ বছরে মাত্র ৪৫ কোটি টাকা মূল্যে ৫০ লাখ কেজি রপ্তানী হয়েছে। দুঃখের বিষয় যে দেশের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে শ্রীলঙ্কা, কেনিয়াসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশ হতে ও চা আমদানি করার উদ্যোগ নেয়ার প্রচেষ্টা চলছে। চা শিল্পের উল্লেখযোগ্য সমস্যাসমূহ আধো আলো আর আধো ছায়ার মধ্যে চা বাগানগুলো তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। ছায়াবৃক্ষ চা বাগানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু ইদানিং অধিকাংশ চা বাগানে ছায়াবৃক্ষ সারিবদ্ধভাবে নির্ধারিত দূবত্বে আর দেখা যায় না। প্রতি হেক্টরে নির্দিষ্ট দূরত্বে ৪০০টি ছায়া বৃক্ষ থাকার কথা কিন্তু বাস্তবে প্রতি হেক্টরে ১০০টি ছায়া বৃক্ষ নেই। আর যেগুলো আছে তা অপরিপক্ক। চা বাগানের ভিতরে এবং বাহিরে এক শ্রেণীর সংঘবদ্ধ চোরের দল ছায়াবৃক্ষ নিধন করছে। সহযোগিতা করছে বাগানের একশ্রেণীর সর্দার, শ্রমিক এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বাবুরাও। বিষয়টি চা বাগানের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। ছায়াবৃক্ষ না থাকলে চা গাছ থেকে সঠিক পরিমাণ চা পাতা জন্মাবে না। চা এর গুণগত মানও ঠিক থাকবে না। কাঁচা সবুজ পাতা দিয়ে চায়ের তৃষ্ণা মেটায় চায়ের বীজ তলা থেকে চারা উৎপাদন করে টিলাভূমিতে চা গাছ লাগিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর নিয়মিত পরিচর্যা করে দুটি পাতা একটি কুড়ি চয়ন করে ফ্যাক্টরিতে কালো চা পাতা উৎপাদনের জন্য নিয়ে যায় যারা, তাদেরকে চা পাতা থেকে বঞ্চিত করা হয় । অনেককেই ১ গ্রাম কালো চা পাতা দেয়া হয় না। অপ্রিয় হলেও সত্য, তারা বাধ্য হয়ে বাগান থেকে সবুজ চা পাতা ঝুরিতে করে বাড়িতে নিয়ে যায় এবং রোদে শুকিয়ে গুড়া করে সেগুলো দিয়ে চায়ের তৃষ্ণা মেটায়। চা বাগানের সরকারী খাসজমি বেহাত হচ্ছে চা বাগানের লিজকৃত জায়গা বেদখল হচ্ছে। কোন কোন চা বাগানের মালিক লিজকৃত জমি স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশ চা ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকায় ইজারা নেয়া জমি অন্য কোন ব্যক্তিকে ইজারা দেয়া যাবে না। ইজারা জমির গাছ কাটাও যাবে না বলেও উল্লেখ আছে কিন্তু চা বাগান কর্তৃপক্ষ এ নিয়মের অমান্য করে জমি ইজারা দিচ্ছে এবং বিভিন্ন প্রজাতির গাছ নিয়মিত কাটছে। চা বাগানের শ্রমিকরা জড়িয়ে পড়ছে চোরা চালানে প্রতিবেশি দেশ ভারতের সাথে চা বাগানগুলোর সীমান্ত এলাকা আছে। চা বাগানের প্ল্যান্টেশন ভারত সীমান্ত স্পর্শ করেছে এমন অনেক চা বাগান আছে মৌলবী বাজার ও হবিগঞ্জ জেলায়। এই সকল বাগানের বেকার শ্রমিকরা জীবিকার সন্ধানে ভারতের সাথে বিভিন্ন রকম জিনিস পত্রের চোরা চালানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তারা ভারতে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কমমূল্যে ভোগ্য পণ্য অথবা সাইকেলের যন্ত্রাংশসহ অন্যান্য জিনিস পত্র কিনে আনে এবং এর পরিবর্তে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সস্তা দ্রব্যাদি সেদেশে পাঠায়। তাছাড়া কিছু শ্রমিক ভারতের সীমান্তবর্তী পাহাড় থেকে গাছ কেটে এনে বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকে। কাঁঠাল, বাঁশ শ্রমিকরা প্রকাশ্যে সীমান্ত এলাকা থেকে চুরি করে এনে শ্রীমঙ্গল শহরে বিক্রি করে। বাগান কর্তৃপক্ষ এদের কাছে নিরুপায়। মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে... চা বাগানে মাদক ব্যবসা একটি নিয়মিত ব্যবসা। কেউ তাকে অন্যায় অনিয়ম মনে করে না। প্রতিটি বাগানে প্রতিটি লাইনে এক থেকে একাধিক মদের দোকান আছে। এই দোকানে মহিলারাও মদ বিক্রি করে। নিজেরা বাড়িতে মদ তৈরি করে এবং বিক্রি করে টাকা উপার্জন করে থাকেÑ এটাই চা বাগানের নিয়ম। এই জীবন থেকে এদের তুলে আনার কোন পথ খোলা আছে কিনা এলাকার সচেতন নাগরিকবৃন্দ ভেবে দেখতে পারেন। চা বাগানের পাশেই রয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের সরকারী অফিস তারাও এই ব্যাপারে সচেতন হতে পারেন। শিশুশ্রম যেখানে প্রচলিত দেশীয় একটি কোম্পানীর চা বাগানে প্রায় ৩০০ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজে নিয়োজিত। তাদেরকে মজুরী হিসেবে দেয়া হয় পূর্ণ বয়স্ক লোকদের প্রাপ্ত মজুরীর অর্ধেক। শ্রম আইনে শিশু শ্রম সম্পূর্ণ নিষেধ থাকা সত্ত্বেও চা কোম্পানীগুলো নিয়মবর্হিভূতভাবে বাগানের কাজে এদেরকে নিয়োজিত রেখেছে। উল্লেখ্য, শিশু শ্রম জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত এবং স্বীকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘন। সংকুচিত হচ্ছে চা চাষের সম্ভাবনা বিভিন্ন দেশী ও বিদেশী চা বাগাগুলোতে ইদানিং তাদের দখলে থাকা অনাবাদি খাস জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে যা চা বাগানের জন্য পরিবেশবান্ধব নয়। নগদ অর্থ লাভের আশায় রাবার চাষের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে চা বাগান কোম্পানীগুলো। কোন কোন চা বাগানে চা ফ্যাক্টরির পাশাপাশি রাবার ফ্যাক্টরি চলমান। চা বাগানের চা যাচ্ছে চা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত ওয়ার হাউজে এবং সেখান থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চা দেশে বিদেশে বিক্রি হচ্ছে এ থেকে সরকারের রাজস্ব আসছে নিয়মিত। চা বাগানে রাবার চাষ করে সুকৌশলে চা বাগানকে চা চাষ সম্প্রসারণ থেকে বিরত রাখা হচ্ছে। রাবার চাষ যদি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে তাহলে অচিরেই চায়ের উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং দেশ বঞ্চিত হবে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে। বেকার হয়ে পড়বে এ শিল্পে নিয়োজিত লাখ লাখ শ্রমিক। উল্লেখ্য, আনুপাতিক হারে রুগ্ন চা বাগানে পরিত্যাক্ত চা চাষ এলাকায় নতুন চা আবাদ হচ্ছে না ফলে উৎপাদন বাড়ছে না। খাস জমি চা বাগানকে দীর্ঘ মেয়াদি বন্দোবস্ত দেয়া হয় চা চাষ করার জন্য এখানে অর্থকরী ফসল হিসেবে বারার চাষ কাম্য নয়। হারিয়ে যাচ্ছে বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী গত বছর কয়েকটি চা বাগানে স্থানীয় ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক কয়েকশত একর প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক বনকে অহরহ ধ্বংস করছে আশপাশের অবস্থিত চা বাগানের শ্রমিকগণ। ২০০৭ সালে নারায়ণ ছড়া চা বাগানে একটি ভাল্লুককে শ্রমিকরা মেরে ফেলে যা পরবর্তীতে বন বিভাগকে অবহিত করা হয়। ২০০৮ সালে জুলাই মাসে একটি মায়া হরিণ মির্তিংগা চা বাগানের শ্রমিকরা ধরে ফেলে যা পরবর্তীতে বন বিভাগের কর্মকর্তা কর্তৃক উদ্ধার করে লাউয়াছড়া বনে ছেড়ে দেয়া হয়। তাছাড়া কাঁঠবিড়াল, মেছো বাঘ, খরগোসসহ নানা রকম বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী চা বাগানের বিস্তীর্ণ সবুজ এলাকায় মাঝে মধ্যে এখনও দেখা যায়। বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক বন দেশের অমূল্য সম্পদ, একে রক্ষা করা এবং রক্ষা করতে সহায়তা করা সকল নাগরিকের দায়িত্ব। কোন চা বাগানে পুলিশ ফাঁড়ি নেই মৌলভীবাজার জেলাসহ বৃহত্তর সিলেট জেলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রয়েছে চা বাগান। রয়েছে লাখ লাখ শ্রমিকের বসবাস। তাই এ সকল দুর্গম এলাকার জন্য আলাদা পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন জরুরী। অন্যথায় এক সময় এই সমস্ত এলাকা অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। নাগরিক নিরাপত্তার স্বার্থে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া দরকার। (সমাপ্ত)
×