ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অদম্য পদযাত্রা আজ

শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে চলা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৬ মার্চ ২০১৮

শহীদ মিনার থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে চলা

মোরসালিন মিজান ॥ স্বাধীনতা পাওয়া হলো বাঙালীর। আহা স্বাধীনতা! সেই ২৬ মার্চ এসেছে আবার। শ্রেষ্ঠ অর্জনের দিনে আজ সোমবার উৎসব অনুষ্ঠানে মুখর হয়ে উঠবে বাংলাদেশ। কিন্তু একটি উদ্যোগ সত্যি আলাদা। অন্যরকম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একদল মানুষ আজ লাল সবুজের পতাকা কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বের হবেন। ভোরে শুরু করবেন পদযাত্রা। মামুলি হাঁটা নয়। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। ইতিহাসের পথ ধরে এগিয়ে চলা। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, সৌধ, বীর সমাধি, বধ্যভূমি, টর্চার সেলের সামনে সবাই দাঁড়াবেন। অনুভব করবেন একাত্তরের সেই বেদনা আর গৌরবমাখা দিনের স্মৃতি। উদ্যোগটির শিরোনামÑ শোক থেকে শক্তি : অদম্য পদযাত্রা। ব্যতিক্রমী সূচনা হয়েছিল ২০১৩ সালে। পর্বতারোহীদের সংগঠন অভিযাত্রী প্রথমবারের মতো এ আয়োজন করে। তখন ছিল শুধুই পদযাত্রা। ২০১৬ সাল থেকে বিশেষ মাহাত্ম যোগ হয়। আরও অর্থবহ হয়ে উঠে। কারণ ওই বছর থেকে উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। স্বাধীনতা দিবসের সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে হেঁটে এগিয়ে যান বিভিন্ন বয়সী মানুষ। অভিযাত্রা শেষ হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নির্মাণ তহবিল সংগ্রহের কাজও করে এই পদযাত্রা। আজকের অদম্য পদযাত্রাটিও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহায়তায় ভূমিকা রাখবে। জানা যায়, আজও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অভিযাত্রীদল প্রথমে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমবেত হবেন। বিভিন্ন বয়সী মানুষের সমাবেশ ঘটবে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত প্রাঙ্গণে। নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে যোগ দেবে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। ভারতেশ্বরী হোমস্ স্কুল ও মানিকনগর মডেল হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের একটি দল অংশ নেবে পদযাত্রায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টুরিস্ট সোসাইটি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাডভেঞ্চার ক্লাব, বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং এ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাব, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, হিমু পরিবহন, ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’র সদস্যরা নিজ নিজ সংঘ সংগঠনের পক্ষে যোগ দেবেন। ‘অদম্য পদযাত্রা’র সংগঠকদের অন্যতম একজন এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদার। দেশের মুখ উজ্জ্বল করা এই তরুণী মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পাশে থেকে নানা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তিনি জানান, আজ ভোর ৬টায় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সূচনা করা হবে পথচলার। এরপর অভিযাত্রী দল এগিয়ে যাবে জগন্নাথ হল বধ্যভূমির দিকে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সংগঠিত গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন তারা। এই পর্ব শেষ করে ভিসি চত্বরে নির্মিত স্মৃতি চিরন্তনের পাশ দিয়ে হেঁটে এগিয়ে যাবে। নীলক্ষেত, কাঁটাবন, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, পিলখানা, জিগাতলা হয়ে পৌঁছে যাবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া বীর তাজউদ্দিন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত বাসভবনের সামনে। এখানে দলের সঙ্গে মিলিত হবেন বীর উত্তম কমল সিদ্দিকী। ছায়ানট, তক্ষশীলা বিদ্যালয় ও ব্রতচারী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এখান থেকে দলের সঙ্গে যুক্ত হবে। সবাই মিলে বীর উত্তম কমল সিদ্দিকী সড়কটি ধরে এগিয়ে যাবেন। জানা যায়, অভিযাত্রা সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ পৌঁছে যাবে মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজ প্রাঙ্গণে। হ্যাঁ, একাত্তর সালে এটি ছিল বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর টর্চার সেল। নিরিহ বাঙালীদের ধরে এনে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো এখানে। দুঃসহ বেদনার সেই ইতিহাস স্মরণ করবে তারা। অভিযাত্রীদল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পৌঁছবে সকাল ১০টা নাগাদ। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে তারা। মিরপুর মাজার রোড, আমিনবাজার ব্রিজ হয়ে এগিয়ে যাবে পদযাত্রা। স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে, হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে এ পথেই ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। অবশ্য একাত্তরে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে বাংলাদেশের নদীপথ। গেরিলা যোদ্ধারা নৌকো করে বহু পথ পাড়ি দিয়েছেন। বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। অভিযাত্রী দল সেইসব দিনের স্মৃতি খুঁজে নিতে দিয়াবাড়ি ঘাট থেকে নৌকায় চড়বে। এভাবে তুরাগ নদ পাড়ি দেবেন তারা। দুপুরের আগে আগে পৌঁছে যাবে সাদুল্ল্যাপুরের শতবর্ষী বটমূলে। আকরাইন এলাকায় পৌঁছবে দুপুর ২টা নাগাদ। এখান থেকে পদযাত্রায় যুক্ত হবে আকরাইন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ পর্যায়ে কিছু সময়ের বিরতি। পরে দল ছুটে যাবে কলমা গ্রামের দিকে। পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী বাঙালীর সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে আছে কলমা গ্রাম। এ গ্রামেই শহীদ হন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা টিটো। এখান থেকে পদযাত্রীদল এগিয়ে যাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। বিকেল ৪টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছার কথা। এর আগে ডেইরি ফার্ম গেটে শহীদ টিটোর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন সবাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, হিমু পরিবহন সাভার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে দলটি চলে যাবে ক্যাম্পাসের অপর প্রান্তের স্কুল গেটে। এই পথে গোকুলনগর গ্রামের মেঠো পথ ধরে এগিয়ে গেলেই জাতীয় স্মৃতিসৌধ! সেখানে উপস্থিত হয়ে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করবেন অভিযাত্রীরা। দেশ গড়ার নতুন শপথ নেবেন। আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে শেষ হবে অদম্য পদযাত্রা। আয়োজন সম্পর্কে কথা হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলীর সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে একদল অভিযাত্রী ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিলেন। বিশ্ব বিবেক জাগরণ পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন তারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে পরিচালিত হওয়া অভিযাত্রাটি আজ ইতিহাসের অংশ। চেতনার জায়গা থেকে দেখলে আজকের অদম্য পদযাত্রা একই অর্থবহন করে। উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে আজকের তরুণরা আরও ভালভাবে মুক্তিযুদ্ধকে জানার সুযোগ পাচ্ছে। প্রতীকীভাবে এক মাইল হেঁটে এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সহায়তায় সাধ্য অনুযায়ী অনুদান প্রদানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যে কেউ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের জন্য সহযোগিতা করতে পারবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যানারসহ ছাত্রছাত্রীরা পদযাত্রায় অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিকাশের জন্য যথাসাধ্য অর্থ সহায়তা প্রদান করতে পারবে বলেও জানান তিনি। পদযাত্রা মেহেরপুর ॥ অদম্য পদযাত্রা ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢাকার বাইরে। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাজধানী ছিল মুজিবনগর। ঢাকার আদলে সেখানেও এই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। স্বাধীনতা দিবসের সকালে মেহেরপুর শহরের গণকবরে (স্মৃতিসৌধ) শ্রদ্ধা জানিয়ে পদযাত্রা শুরু হবে। মুজিবনগর সড়ক ধরে প্রায় পনেরো কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পদযাত্রীদল পৌঁছাবে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে। সর্বসাধারণের পাশাপাশি মেহেরপুর শিল্পকলা একাডেমি, অরণী থিয়েটার, আমঝুপি মিলেনিয়াম, হিমু পরিবহন কুষ্টিয়া এই পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করবেন এবং রোটারি ক্লাব অব কুষ্টিয়া মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে একাত্ব হয়ে গ্রহণ করবেন তারুণ্যের দৃপ্ত শপথ।
×