ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

একটি ডাকে জাগে সাত কোটি প্রাণ

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২৬ মার্চ ২০১৮

একটি ডাকে জাগে সাত কোটি প্রাণ

একাত্তর সালে একটি ডাকে জেগেছিল সাত কোটি প্রাণ রণাঙ্গনে। সেই ডাক ছিল ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ এই অমোঘ ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দিয়েছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বকণ্ঠে এই ঘোষণা প্রদানের পর দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ জনগণ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এই ঘোষণা প্রদানের একমাত্র অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর, যা জাতি সত্তরের নির্বাচনে সে ক্ষমতা প্রদান করেছিল। বাংলাদেশের জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার ধারকে পরিণত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে। যে জাতীয় চেতনার উন্মেষের ফলে আমাদের সময়কালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটেছে; সেই জাতীয় চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। পাকিস্তান নামক ‘অদ্ভুতুড়ে’ রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস করে তিনি তার জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সহস্র বছরের মধ্যে বাঙালীর ওই প্রথম গণজাগরণ ঘটেছিল একাত্তর সালে এসে। এমনিতেই জন্মমুহূর্ত থেকেই পাকিস্তান ছিল এক সমস্যাসঙ্কুল রাষ্ট্র। কারণ এর বাস্তবতা এবং এর মানসিকতায় কোথাও মিল পাওয়া যায়নি। প্রকট হয়ে উঠেছিল দেশ শাসন সংক্রান্ত সমস্যাগুলো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর শাসনক্ষমতা মুসলিম লীগের পাকিস্তানী পন্থীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। মুসলিম লীগের বাঙালীরা হয়ে পড়ে তাদের তল্পিবাহক। বাঙালী জাতি হয়ে পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রজা। শোষণের ভারে জর্জরিত ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে দু’টুকরো করার পর ভারত গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত হতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান হয়ে পড়ে গোলমেলে এক রাষ্ট্র। কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলো না চালু। বিফলে গেল সংবিধান প্রণয়নের নানা প্রচেষ্টাও। বিরোধী পক্ষের কণ্ঠরোধ, যথাসময়ে নির্বাচন আয়োজনও সম্পন্ন করা হয়নি। দেশভাগ পূর্ববর্তী অখ- বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বিতাড়িত জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছিল। দেশত্যাগে বাধ্য হয়ে প্রবাসে নির্বাসিত জীবনে মৃত্যুবরণ করেন বাঙালীর প্রিয় নেতা গণতন্ত্রের মানসপুত্রখ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ততদিনে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে পূর্ববঙ্গকে নিষ্পেষণের নানা ফন্দি ফিকির চালায়। পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে শেখ মুজিবসহ আর বাঙালী নেতার প্রতিবাদের মুখে করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’। আঘাত হানা শুরু হয় বাঙালীর শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর। সোহরাওয়ার্দীর জীবনাবসানের পর তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দায়িত্ব বর্তায় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুরের ওপর। মওলানা ভাসানীসহ আরও কতিপয় ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা দলছুটরা গঠন করেছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয় বাস্তবতার নিরিখে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে। দলটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয়ে হয়ে ওঠে সক্ষম। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব সাহসী ও অক্লান্তকর্মী হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করে সারাদেশে সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৫৪ সালে এরা সবাই জোটবদ্ধ হয়ে প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে লড়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন প্রবীণ নেতা শেরেবাংলা। নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট এবং মুসলিম লীগের ভাগ্যে জুটেছিল ধস নামানো পরাজয়। পূর্ববাংলার বাঙালীরা মুছে দিয়েছিল মুসলিম লীগের অস্তিত্ব। এরপর ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে ১৭ দিনের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হলে অসম্মানজনক তাসখন্দ যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে হয় জান্তাশাসক আইয়ুব খানকে। এই যুদ্ধের সময় পূর্ববঙ্গ ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ভারত চাইলে স্বল্প সময়ের মধ্যে দখল করে নিতে পারত বিনা প্রতিরোধে। যুদ্ধকালে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রতিরোধের জন্য মোতায়েন করা হয়নি সেনা। অবশ্য ভারত পূর্ববঙ্গে আক্রমণের চেয়ে পাকিস্তানে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে পর্যুদস্ত করেছিল পাকিহানাদার সেনাদের। পাকিস্তানের এই পরাজয় বাঙালীদের ক্ষুব্ধ করে। শেখ মুজিব এই বিষয়গুলো জনগণের সামনে নিয়ে আসেন। ঘোষণা করেন ঐতিহাসিক ছয় দফা। সারা বাংলার মানুষ ক্রমান্বয়ে এই কর্মসূচীর প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে। কারণ বাঙালি ও পাকিস্তানীদের অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছিল প্রতিবছর। সেই সঙ্গে ক্ষমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সংস্কারের দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিল ক্রমশ প্রতিদিন। পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা রাজনৈতিক মীমাংসার পথে না গিয়ে ছয় দফার দাবিদার শেখ মুজিবকে কার্যত আইনের অস্ত্রে ঘায়েল করতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্তের দায়ে দায়ের করা কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিব হলেন প্রধান অভিযুক্ত। বাংলার বাঙালী এটাকে দেখলো মুজিবের বিরুদ্ধেই শুধু চক্রান্ত নয়, বাঙালী জাতিকে আরও নিষ্পেষিত, কণ্ঠরোধ করা, অধিকারহীন অবস্থানে নিয়ে যাওয়ারও ষড়যন্ত্র। ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হলো। তারা ছয় দফার আলোকে ঘোষণা করলো এগার দফা। গর্জে উঠল সারা বাংলা। সামরিক শাসক আইয়ুব খানের গদি টলমল। সারা পূর্ববাংলায় ছড়িয়ে পড়ে গণআন্দোলন। তার ঢেউ লাগে পাকিস্তানের সর্বত্রও। গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় আইয়ুব দশ বছর টানা শাসন শেষে। তবে উত্তরসূরি হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া শাসনভার বহনের দু’বছরের মাথায় একাত্তরের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা চালায়। ইয়াহিয়া ক্ষমতা নিয়ে বেতারে যে ভাষণ দেন, তাতে পাকিস্তানের অখ-তা ও সংহতি রক্ষার ওপরেই জোর দেন। বিশেষভাবে জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা। বাঙালী বুঝে নিল ক্ষমতা এক জেনারেল থেকে আরেক জেনারেলের হাতে পড়েছে। সামরিক শাসনমুক্ত হয়নি জাতি। বরং নতুন করে সামরিক ফরমান জারি শুরু হয়। ক্ষমতা দখল করে ইয়াহিয়া যে ভাষণ দেয়, তাতে বাঙালীর কাছে স্পষ্ট হলো যে, আর এক সঙ্গে থাকা যাবে না। আইয়ুবের দশ বছরের দুঃশাসন অন্য জেনারেলের হাতে প্রলম্বিত হয়েছে কেবল। ষাটের দশক থেকে যে বাঙালী স্বাধিকারের জন্য লড়াই শুরু করে, দশকের শেষ প্রান্তে এসে সে লড়াইকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে এগিয়ে নিতে থাকে। ‘আজ থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের’ ভাবনাটা শেখ মুজিব তার জনগণের মধ্যে সম্প্রসারিত করতে পেরেছিলেন। সামরিক আইনের কাঠামোর মধ্যে হলেও ইয়াহিয়া গণচাপে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। সত্তরের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু জনগণের কাছ থেকে ছয় দফা ইস্যুতে ম্যান্ডেন্ট পেলেন। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এককভাবে সরকার গঠনের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। শেখ মুজিব নির্বাচনকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তো হলোই না বরং শুরু হয় ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানী শাসক সামরিক গোষ্ঠী জনগণের এ রায় আশা করেনি। তাই তারা তা মেনে নিতে গররাজি হয়ে ওঠে। জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকে তা আবার স্থগিত করে। বাঙালীর এতো বড় বিজয় নস্যাতের পাকিস্তানী অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ শুরু হয় সারা বাংলায়। এই প্রতিবাদ ছিল নজিরবিহীন। শহর বন্দর গ্রাম জেগে ওঠে স্বাধীনতার মহান লক্ষ্য সামনে রেখে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জোরালো সংগ্রামের পথে ধাবিত হয়। সবকিছু অচল হয়ে পড়ে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। সারা বাংলা তখন শেখ মুজিবের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হতে থাকে। পাকিস্তানী শাসকদের অস্তিত্ব কেবল সেনাছাউনিতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত রাখার দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। পূর্ববাংলার মানুষ স্বাধিকারের দাবিকে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত করে। দেশ জুড়ে বাঙালী ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে স্বাধীনতার পক্ষে। শুরু হয় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। ছাত্র-ছাত্রী, যুবা-যুবতী থেকে শুরু করে পেশাজীবীরাও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে দেশের বিভিন্ন স্থানে। পহেলা মার্চের পর বাঙালী বুঝে নেয়, পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে কোন মীমাংসা সম্ভব নয়। তারা স্বাধীনতার পথকেই বেছে নেয়। শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের সাড়া ছিল অভাবনীয়। সর্বত্র একই আওয়াজÑ স্বাধীনতা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থানে বাঙালীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে শতাধিক বাঙালী শহীদ হয়। ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর আলোচনাকালে অনেকের মনে হয়েছে, রক্তপাত এড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালী বুঝে নেয়, রক্তপাত ছাড়া স্বাধীনতা অর্জনের কোন উপায় নেই। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ চলাকালে পাকিস্তানী বিমান ও হেলিকপ্টার সমাবেশস্থলের ওপর বারবার চক্কর দেয়। হামলার পরিকল্পনাও ছিল তাদের তখন। আলোচনা অসমাপ্ত রেখেই রাতের অন্ধকারে গোপনে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ঢাকা ত্যাগ করে। আর দেশটিকে এক নিষ্ঠুর সামরিক আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দেয়। ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যরাতের তথাকথিত অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে। বাঙালী আজও ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস স্মরণ করে আসছে। এখন এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করা হচ্ছে জাতিসংঘের কাছে। মহান নেতা শেখ মুজিব ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে স্বাধীনতার কঠিন অভিযাত্রায় সর্বাত্মক লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন। পুরো জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই ডাক শুনে দখলদার হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে হটাতে। সর্বত্র রুখে দাঁড়ায় বাংলার জনগণ। নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হতে থাকে। বাঙালী জড়িয়ে পড়ে এক অসম যুদ্ধে। যে যুদ্ধ পাকিস্তানী জান্তা চাপিয়ে দিয়েছে তাদের ওপর। পাকিস্তানী সেনারা নির্বিচারে গণহারে বাঙালী নিধনে মত্ত হয়ে ওঠে। রাস্তাঘাট রিক্সায়, গাড়িতে, ঘরে, বাড়িতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে, ছাত্রাবাসে এবং যানবাহনে বাঙালী নিধন পর্ব অব্যাহত রাখে হানাদাররা। শুরু হয় নারী জাতির ওপর নৃশংস অত্যাচার, ধর্ষণ। প্রকাশ্য দিবালোকে নারীর স্তন কেটে বেয়নেটের মাথায় নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে হানাদার সেনারা। গ্রামগঞ্জে শহরে ধর্ষিত হতে থাতে নারী। বেয়নেটের ডগায় শিশুরা উড়তে লাগল রক্তাক্ত নিশানের মতো। অস্ত্র হাতে ধরতে না শেখা বাঙালী অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে থাকে বাঙালী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে হানাদার ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা দেশের শিক্ষিত গুণীজনদের ঘর থেকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে চোখ বেঁধে নির্যাতনের পর বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তাঞ্চলে ১০ এপ্রিল গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম সরকার। সেই সরকারের অধীনে পরিচালিত হয় যুদ্ধ। সারা বাংলা তখন জেলখানা। হানাদার ও তার সহযোগী আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটি, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনীর সম্মিলনে সারাদেশ নরকে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার জন্য বাঙালীদের করণীয় বিষয়ে ঘোষণা যেমন দেয়া হতো তেমনি পাকিদের নিধনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথাও বলা হতো। হানাদারদের অত্যাচারে দেশত্যাগে বাধ্য কোটি খানেক বাঙালী শরণার্থী সেদিন ভারতের মহানুভবতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং খাবার পেয়েছিল। বাঙালীর সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসের এই হচ্ছে সার সংক্ষেপ। এর ভেতর কত শাখা, প্রশাখা, উপশাখা, ডালপালা বিস্তৃত রয়েছে যে, তার সবটুকু আজও জানা হয়নি সবার। বাঙালী ইতিহাসমনস্ক জাতি নয়; হলে তার রচিত ইতিহাস হতো সমৃদ্ধ এবং বিশ্বসেরা। কিন্তু আজ নানা বিকৃতি এসে ইতিহাসকে গ্রাস করতে চায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা হয়নি। সরকারীভাবে এজন্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যা হয়েছে, তা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। মুক্তিযোদ্ধারা পরপারে চলে যাচ্ছেন। স্মৃতিকথা বলার ও লেখার মানুষ কমে যাচ্ছে। তাই অচিরেই ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করা যেতে পারে। আর এ কাজটি সর্বাগ্রে করার দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দল আওয়ামী লীগের। কিন্তু তারা যেভাবে নির্বিকার, তাতে বিকৃতিই প্রাধান্য পাচ্ছে ক্রমাগত।
×