ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গণপরিবহনে ‘চিটিং’

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১২ মার্চ ২০১৮

গণপরিবহনে ‘চিটিং’

রাজধানীতে গণপরিবহন ব্যবস্থায় বিশেষ করে মিনিবাস তথা ছোট বাস সার্ভিসে ‘সিটিংয়ের’ নামে ‘চিটিং’ বন্ধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। বাস্তবে সিটিং সার্ভিস বলতে কিছু নেই। প্রায় সব বাস, মিনিবাসই দাঁড়িয়ে তথা লোক গাদাগাদি করে যাত্রী পরিবহন করে থাকে, বিশেষ করে অফিস টাইমের শুরু ও শেষে। অথচ সবার কাছ থেকেই ভাড়া আদায় করা হয় সিটিংয়ের। আর এর নামেরও কত বাহারÑ সিটিং, কম স্টপেজ, গেটলক, স্পেশাল, কাউন্টার সার্ভিসসহ আরও কত কী! মাইলপ্রতি বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া প্রায় কোন মালিক পক্ষই মানছে না। ফলে বাস ড্রাইভার, কনডাক্টরদের তো পোয়াবারো। যাত্রীদের জিম্মি করে মর্জিমাফিক চলে ভাড়া আদায়। এ নিয়ে নিত্যদিন যাত্রীদের সঙ্গে বচসাও কিছু কম হয় না। এর পাশাপাশি সর্বাধিক বিড়ম্বিত হতে হয় নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি করে তারা উঠতে পারেন না গণপরিবহনে। কখনও কায়ক্লেশে উঠতে পারলেও সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও কোন অবস্থাতেই মেলে না বসার আসন। আর যথেচ্ছ ভাড়া আদায়ের তো কথা লেখাই বাহুল্য। রাজধানীতে গণপরিবহনে নৈরাজ্য নতুন নয়। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে গত বছরের এপ্রিলে সব রকম সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। আসলে সেটি ছিল ভাড়া কমানোর পরিবর্তে ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা। কেননা সিটিংয়ের নামে ‘চিটিং’ তথা প্রতারণা করে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় চলছিল আগে থেকেই। এখন ভাড়া না কমিয়ে আগের নির্ধারিত ভাড়া আদায়ই চলছে বসে এবং দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে। তদুপরি কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বাসও নামানো হচ্ছে কম, তিন ভাগের এক ভাগ। ফলে অফিসগামী এবং অফিস ফেরত যাত্রীসাধারণ স্বভাবতই পড়ছেন অবর্ণনীয় দুর্ভোগে। এর বাইরে সাধারণ মানুষ, নারী-পুরুষ-শিশু ও শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগও সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এক সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতি তিন হাজার যাত্রীর জন্য রয়েছে মাত্র একটি বাস ও মিনিবাস। অটোরিক্সাগুলোর মধ্যে প্রতিদিন অচল থাকে এক-তৃতীয়াংশ। ট্যাক্সিক্যাব যেন সোনার হরিণ। বাস্তবে গণপরিবহনের কোন ধারণাই গড়ে ওঠেনি- না সরকার, না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, না বিআরটিএর। জনসংখ্যা ও রাস্তাঘাট বিবেচনায় অন্তত এই মুহূর্তে রাজধানীতে প্রয়োজন ১২ থেকে ১৩ হাজার বাস। বর্তমানে চলছে বড়জোর তিন হাজার। বিআরটিএর ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী রাজধানীর ১৬৮টি রুটে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা পাঁচ হাজার ৪০৭টি। এর মধ্যে মিনিবাস তিন হাজার, আর বাস আছে মাত্র দুই হাজার ২৮১টি। তবে পরিবহন মালিকদের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা চার হাজারের কম। এই অবস্থায় সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে রাজধানীতে তিন হাজার নতুন বাস নামানোর পরিকল্পনাটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র ও পরিবহন মালিক সমিতির উদ্যোগে এই প্রক্রিয়া অনেকটা অগ্রসর হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বাংলাদেশ ব্যাংকেরও সাড়া মিলেছে। প্রস্তাবও মোটামুটি চূড়ান্ত। বর্তমানে পরিবহন খাতে বাস মালিকদের ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ। এতে তাদের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়। সরকারের তরফ থেকে এবার এই কর মওকুফ করে দেয়ার আশ্বাস মিলেছে। তিন হাজার নতুন বাসের জন্য ৪৫০ কোটি টাকা সরকারী ভর্তুকির বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। ঋণের চার ভাগের দায়িত্ব মালিকদের। প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে সচল ১৯০টি পরিবহন কোম্পানিকে একীভূত করে পাঁচটি কোম্পানি করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৭ সালের মার্চের মধ্যে তিন হাজার নতুন পাবলিক বাস চালুর কথা থাকলেও সেটা হয়নি। নতুন বাস নামানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরনো জরাজীর্ণ লক্কড়-ঝক্কড়মার্কা বাসগুলো প্রত্যাহার করে নেয়া হবে বলেও বলা হয়েছে। অকালপ্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে পরিকল্পনাটি যেন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে। নতুন তিন হাজার বাসের মধ্যে এসি-নন এসি দুটোই থাকার কথা। ভাল কথা, তবে বাসগুলো যেন সচল থাকে এবং টেকসই হয় তা নিশ্চিত করা দরকার। বিআরটিসিসহ বর্তমানে সচল বাস-মিনিবাসগুলোর জরাজীর্ণ চেহারা দেখলে রীতিমতো করুণা হয়। নতুন বাসের ক্ষেত্রে যেন অনুরূপ অভিজ্ঞতা না হয় নগরবাসীর তা নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে।
×