ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাড়াটিয়াবেশী দুই সিরিয়াল কিলার তেজগাঁওয়ে গৃহকর্ত্রীকে খুন করে

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ১০ মার্চ ২০১৮

 ভাড়াটিয়াবেশী দুই সিরিয়াল কিলার তেজগাঁওয়ে গৃহকর্ত্রীকে খুন করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সিরিয়াল কিলাররা রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পশ্চিম নাখালপাড়ায় গৃহকর্ত্রী আমেনা বেগমের (৬৫) খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় পুলিশ ভাড়াটিয়াবেশী খুনী দুই যুবককে খুঁজছে। তবে হত্যাকা-ের ৩৬ ঘণ্টা পার হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশ জানায়, দুই বছর আগে একইভাবে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের অনেক মিল রয়েছে। ইতোমধ্যে হত্যাকারীদের শনাক্তের জন্য পুলিশ আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ, নিহতের পরিবার ও স্থানীয়দের সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সিআইডি ক্রাইম সিন ঘটনাস্থল থেকে নিহতের মাথার খুলির টুকরো, চুলসহ বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সূত্র জানায়, ভাড়াটিয়াবেশী সিরিয়াল কিলাররা ধারালো ও ভারি কোন অস্ত্র ব্যবহার করেছে। কারণ ধারালো অস্ত্রের এক কোপে আমেনা বেগম খুন হয়েছে। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, ভাড়ার বাসা দেখতে এসে ওই বৃদ্ধা খুনের শিকার হয়েছে কিনা। নাকি তাদের পরিবারের কেউ এ ঘটনায় জড়িত আছে কিনা। তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এর আগে রাজধানীর দক্ষিণখানে ভাড়াটিয়াবেশী সিরিয়াল কিলাররা একইভাবে বাড়ির মালিকসহ তিনজনকে খুন করেছে। ওই সব ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সিরিয়াল কিলার হিসেবে অজ্ঞাত এক যুবককে পুলিশ এখনও খুঁজছে। ওই চক্রটি নাখালপাড়ার খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা। তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পশ্চিম নাখালপাড়ার ২৮৮ নম্বর বাড়ি ‘রসুল ভিলা’। পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় বাড়ির মালিকের দুই ছেলে পরিবার নিয়ে থকেন। ভবনের নিচতলা ও চতুর্থ তলায় দুটি ফ্ল্যাট খালি। এজন্য বাড়ির সামনে টু-লেট সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার দুপুরে ওই বাসায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে এসে বাড়ির মালিকের স্ত্রী আমেনা বেগমকে (৬৫) কুপিয়ে হত্যা করে এক দুর্বৃত্ত। হত্যার পর ওই গৃহকর্ত্রীর গলার চেন ও হাতে থাকা স্বর্ণের চুড়ি খুলে নিয়ে যায় ভাড়াটিয়াবেশী খুনীরা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ঘটনার সঙ্গে ২০১৬ সালে রাজধানীর দক্ষিণখানে তিন গৃহকর্ত্রী খুন ও দুজনের আহত হওয়ার ঘটনার মিল খুঁজে পাচ্ছেন তারা। মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাসা ভাড়া নিতে আসা যুবকের হাতে সিরিয়াল কিলিংয়ের ওই ঘটনাগুলো ঘটেছিল। যার কূল কিনারা এখনও করতে পারেনি পুলিশ। খুনীরা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। নিহতের পরিবার জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে এক যুবক বাসার কলিংবেল চাপলে গৃহকর্ত্রী আমেনা বেগম দরজা খোলেন। ওই যুবক বাসা ভাড়া নেয়ার কথা জানালে তাকে তিনি নিচতলায় ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে যান। সেখানে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় ওই যুবক। তবে নিহতের আরেকটি সূত্র জানায়, ঘটনার সময় দুই যুবক ছিল। একজন ভেতরে ঢুকে। আরেকজন বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল। পুলিশ জানায়, ভবনের নিচতলায় খালি ফ্ল্যাটটির রান্নাঘরের ভেতর ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমেনা বেগমের মাথার পেছনে আঘাত করা হয়েছে। এতে তার মাথা অনেকখানি থেঁতলে যায়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক মোর্তুজা কবীর জানান, ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু আলামত জব্দ করা হয়েছে। নিহতের মাথার খুলির টুকরো ও চুল পাওয়া গেছে। তবে চুলটি কি নিহতের নাকি হত্যাকারীর। সেজন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। তিনি জানান, নিহতের মাথায় দুটি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করছি, হত্যাকারী ধারালো ও ভারি কোনও অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এছাড়া শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন যাওয়া যায়নি। রসুল ভিলার নিচতলার অন্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া মনি বেগম জানান, দুপুরে চিৎকার শুনে আমি দরজা খুলে ঘটনার খবর জানতে পারি। একটা ছেলে নাকি ঘর ভাড়া নিতে এসেছিল। বাইরে আরেক যুবক দাঁড়িয়েছিল। নিহতের ছোট ছেলের স্ত্রী বর্ষা জানান, ঘটনার দিন বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার পরপর কলিংবেলের শব্দ শুনে আমার শাশুড়ি ঘরের দরজা খোলেন। এক যুবক বাসা ভাড়া নিতে আসে। কোন তলায় ভাড়া হবে জানতে চায়। এ সময় শাশুড়ি আমেনা বেগম জানান, নিচতলা ও চার তলায় ভাড়া হবে। ছেলেটি শাশুড়িকে নিচতলা দেখাতে বলে। তখন আমি আর আমার শাশুড়ি ঘরে ছিলাম। তিনি (শাশুড়ি) ওই ছেলের সঙ্গে নিচতলায় যান। ২০ মিনিটের বেশি সময় পরেও তিনি আসছেন না দেখে আমি নিচে যাই। নিচতলার ডান পাশের খালি ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ছিল। ভেতরে গিয়ে দেখি রান্নাঘরে রক্তাক্ত অবস্থায় আমার শাশুড়ি পড়ে আছেন। মেঝেতে রক্ত ছিটকে পড়ে আছে। ওই ছেলেকে পাইনি। পরে তাকে স্থানীয় মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে সরকারী হাসপাতালে নিতে বলা হয়। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেয়ার সময় তার মৃত্যু হয়। পুলিশের তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপ- কমিশনার (এডিসি) সাত্যকি কবিরাজ জানান, ঘটনার তদন্ত একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কাজ করছি। কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তদন্ত চলছে। মামলায় যা ছিল ॥ এদিকে বৃহস্পতিবার গভীররাতে এই ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে (মামলা নম্বর ১২)। নিহতের বড় ছেলে বাবু আহমেদ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে তেজগাঁও থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সেন্টু মিয়া ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে শুক্রবার সন্ধ্যায় তেজগাঁও থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, খুনের ঘটনায় এক থেকে দু’জন জড়িত। তবে খুনী পেশাদার। তাকে শনাক্তের জন্য নিহতের পরিবার ও আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ নেই। তবে ঘটনাস্থল থেকে মূল সড়কে বের হওয়ার সড়কের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। খুনী যদি সেখান থেকে পালিয়ে থাকে। তাতে ধরা পড়তে পারে। তবে এখনও খুনীকে শনাক্ত করা যায়নি। চেষ্টা চলছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বছর দুয়েক আগে রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় ঘটে যাওয়া কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ধরনের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের অনেক মিল রয়েছে। হতে পারে এটিও সিরিয়াল কিলিংয়ের একটি। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইরে বাসা ভাড়া নিতে এসে গৃহকর্ত্রী শাহিদা বেগমকে (৫০) নৃশংসভাবে খুন করে ভাড়াটিয়াবেশী দুর্বৃত্ত। পরদিনই দক্ষিণখানের আশকোনা মেডিক্যাল রোডে গৃহকর্ত্রী মাহিরা বেগমকে (৫০) কুপিয়ে আহত করা হয়। এর এক মাস পর ২১ আগস্ট দক্ষিণখানের তেঁতুলতলা ইয়াছিন রোডে গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া বেগমকে (৫২) একইভাবে কুপিয়ে খুন করা হয়। এর ১০ দিন পর ৩১ আগস্ট দক্ষিণখানের মুন্সি মার্কেট এলাকায় জেবুন্নেছা চৌধুরীকে (৫৬) কুপিয়ে আহত করে অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণখানের উত্তর গাওয়াইরে ওয়াহিদা আক্তার সীমাকে (৪৮) একই কুপিয়ে খুন করা হয়। নিহত গৃহকর্ত্রী আমেনা বেগমের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বড় ছেলে হান্নান বাড়ি দেখাশোনা করেন। মেঝ ছেলে নাসির উদ্দিন ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছোট ছেলে বাবু আহমেদ দেশের বাইরে থাকেন। একমাস আগে তিনি ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছেন। বাড়ির মালিক রসুল মিয়া তিব্বতে চাকরি করতেন। ২০০১ সালে তিনি মারা যান। এরপর থেকে আমেনা বেগম ছোট ছেলের সঙ্গে ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন। বড় ছেলে তার পরিবার নিয়ে তৃতীয় তলায় থাকেন। এছাড়া নিচতলা, চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় দুটি করে মোট ছয়টি ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়ারা থাকেন। গত মাসে নিচতলা ও চতুর্থ তলায় দুটি ফ্ল্যাট খালি হয়। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ার রসুল ভিলা নামে ২৮৮ নম্বর বাড়িতে ঢুকে মালিক আমেনা বেগমকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। বাড়ির দ্বিতীয় তলায় সপরিবারে থাকতেন তিনি। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মরদেহ উদ্ধার শেষে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।
×