ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চালের দাম, শেয়ারবাজার, ব্যাংক সংবাদ ॥ উদ্দেশ্য কী?

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২ মার্চ ২০১৮

চালের দাম, শেয়ারবাজার, ব্যাংক সংবাদ ॥ উদ্দেশ্য কী?

এ সপ্তাহের কলাম লিখতে গিয়ে দেখলাম তিনটি বিষয় আমলে নিয়েই তা লিখতে হবে। বিষয় তিনটি কি? এক নম্বরে চালের দাম, দুই নম্বরে আছে শেয়ারবাজারের উথাল-পাতাল এবং তিন নম্বরে আছে ব্যাংকিং খাতের খবর। বলাবাহুল্য, তিনটি বিষয়ই স্পর্শকাতর। প্রথমটি তো জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। একে অবহেলার কোন সুযোগ আমাদের নেই। এখন ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময়। এরই মধ্যে ঢাকা শহরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। জানি না গ্রামাঞ্চলে হয়েছে কিনা, হলে বোরোর জন্য ভাল হওয়ারই কথা। এরই মধ্যে যদি শুনি যে, চালের দাম আবার বাড়ছে তাহলে তো দুশ্চিন্তার কথাই। কিছুদিন আগে যখন চালের দাম বাড়ছিল তখন তার কিছুটা কারণ ছিল। উপর্যুপরি দুটো বন্যায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। সরকারের হাতে খাদ্যের স্টক কিছুটা কম ছিল। বিদেশের বাজারে চালের প্রাপ্যতাও ছিল সীমিত। এমতাবস্থায় এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। তারা দাম বাড়ায়। সরকারকে কতগুলো জরুরী পদক্ষেপ নিতে হয়। চাল আমদানির ওপর ধার্যকৃত শুল্ক হ্রাস করতে হয়। জরুরীভিত্তিতে চাল সংগ্রহে নামতে হয়। বলাইবাহুল্য, চালের দাম বেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। এখন হঠাৎ করে কি ঘটল যে, বাজারে চালের দাম বাড়তির দিকে? এ খবর দিয়ে একটি দৈনিক একটি স্টোরি ছেপেছে। বোঝা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা আবার তৎপর হয়েছে। শেয়ারবাজারে অপতৎপরতা দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে সঙ্কট সৃষ্টিরও একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এর অর্থ কি? এখন চালের প্রচুর স্টক আছে। সরকার আমদানির মাধ্যমে গত কয়েক মাসে বেশ স্বস্তিজনক খাদ্যস্টক গড়ে তুলেছে। এখন সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক কমপক্ষে ১৪ লাখ টন খাদ্য সরকারের গুদামে স্টক হিসেবে আছে। সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে ৫০ লাখ মানুষকে ১০ টাকায় চাল দেবে কমপক্ষে আরও এক-দুই মাস। এই মানুষগুলো অতিদরিদ্র। এরা মাসে পরিবার প্রতি ৩০ কেজি করে চাল পাবে। এদিকে বোরো ফসলের সময় আগত। ফাল্গুন মাস যায় যায়। চৈত্রের মাঝামাঝি থেকেই কার্যত বোরো ধান কাটা শুরু হয় দেশের অনেক অঞ্চলে। ধরতে গেলে এক মাসও নেই বোরো তোলার। এমন কোন খবরও নেই যে, বোরোর ফলন কম হবে। একমাত্র শিলাবৃষ্টিতে কিছু ফসল নষ্ট না হলে এবারও বাম্পার ফলন হবে। তাহলে হঠাৎ করে চালের বাজারে ব্যবসায়ীরা কেন অপতৎপরতা শুরু করেছে। দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের একশ্রেণীর ব্যবসায়ী যে কোন সুযোগেই মানুষকে কষ্ট দিতে উদ্যত হয়। এই মুহূর্তে বলা হচ্ছে ভারত থেকে চাল আনার খরচ টনে হাজার দুই টাকা বেশি পড়ছে। এরই বোঝা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ভোক্তাদের ওপর। কিন্তু প্রশ্ন, মিলারদের হাতে তো চাল আছে, স্টকে চাল আছে। ওই চালের দাম বাড়ে কিভাবে? অবশ্য এ কথা জানা চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি নিয়ে অতিদরিদ্রদের মধ্যেই চাল বিতরণের কাজ শুরু করা এবং খোলাবাজারে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করা। কারণ, দেখা যাচ্ছে সরকার ব্যবসায়ীদের যত বন্ধু বলেই গণ্য করে না কেন, বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের যত তোয়াজই করেন না কেন, তারা সুযোগ তৈরি করবেই, সুযোগ নেবেই। অতএব কথা কম বলে বাজারে নামা দরকার সরকারের। কারণ চালের মূল্যবৃদ্ধি এককভাবে ঘটছে না। এর সঙ্গে আরও একটি খাতকে অস্থিতিশীল করে তোলার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তা না হলে হঠাৎ কি ঘটল যে, শেয়ারবাজারে আবার পতন নেমে এলো? ভালই তো চলছিল। দৃশ্যত কোন কারণ নেই, অথচ এক রিপোর্টে দেখলাম শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। দৈনিক জনকণ্ঠ শিরোনাম করেছে : ‘শেয়ারবাজারে ভয়াবহ দরপতন জিম্মি ৩৩ লাখ।’ খবরের ভেতরে বলা হয়েছে গত দুই মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেই মূলধন হ্রাস পেয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। সূচক কমেছে ৪৮০ পয়েন্ট। অথচ বিনিয়োগকারীদের উদ্ধার করার কেউ নেই। এই অবস্থা কেন হলো? কারা দুইদিন পর পর ‘জেড’ কোম্পানির শেয়ারের দাম আকাশে তোলে? কারা ভাল মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম অযৌক্তিকভাবে কমায়? কারা অলাভজনক কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ায়? গুজবের পর গুজব ছড়ানো হয় পরিকল্পিতভাবে। বড় বড় কোম্পানি, ব্যাংক, বীমা কোম্পানির মালিকরা সমস্ত শেয়ার উচ্চতম দরে বিক্রি করে ‘দিগম্বর মালিক’ হয়েছেন অনেক আগেই। কোন বিচার-আচার নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বসে বসে তামাশা দেখে তাই নয় কি? নতুবা এসব বিশৃঙ্খলার জন্য কঠোর শাস্তি হয় না কেন? দুই দুইটি শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়েছে, মামলা আছে। অথচ মামলার কোন অগ্রগতির কথা মানুষ জানে না। এরই মধ্যে বাজার স্বাভাবিক নিয়মেই উঠছিল। হঠাৎ কে বা কারা এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করল? এর সঙ্গে কি রাজনীতির কোন সম্পর্ক আছে? থাকলে তা খুবই দুঃখজনক। কারণ রাজনীতি চলবে রাজনীতির মতো, অর্থনীতি চলবে অর্থনীতির মতো। কিন্তু দৃশ্যত মনে হচ্ছে শেয়ারবাজারে একটা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। এর সঙ্গে কি চালের বাজারের সম্পর্ক নেই? আমার মনে হয় আছে। কারণ এই দুটো বাজার খুবই স্পর্শকাতর। চালের সঙ্গে সম্পর্কিত সকল শ্রেণীর মানুষ; বিশেষ করে অতি দরিদ্র ও দরিদ্র মানুষ। এরা ক্রয়ক্ষমতার অভাবে চাল কিনতে পারে না। দ্বিতীয়ত শেয়ারবাজারে রয়েছে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। এরা মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোক। দুইবার তারা মার খেয়েছে। আরেকবার হলে তারা আর বাঁচবে না। তাও এমন সময়ে এখন জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে আসছে। এই সময়ে অস্থিতিশীলতার অর্থই হলো রাজনীতি ও অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি। আমি বিষয়টিকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি আরও একটি কারণে। দেখা যাচ্ছে অনুপাতের হিসেবে আমাদের মিডিয়ার একাংশ খুব বেশি ব্যাংকের অনিয়মের ওপর খবর দিচ্ছে। নতুন নতুন খবর হলে একটা কথা ছিল। বিশ্লেষণমূলক খবর হলে একটা কথা ছিল। না, তা নেই। দেখা যাচ্ছে একটা খবর একটা কাগজ ছাপল তো পরেরদিন একই খবর আরেকটা কাগজ ছাপল। দুটো খবরের মধ্যে গুণগত কোন পার্থক্য নেই। আলোচনা শুধু সমস্যার। সমাধানের পথ কেউ দিচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতে সমস্যাগুলো দীর্ঘদিন যাবত আলোচিত। এর মধ্যে এক নম্বর সমস্যা হচ্ছে শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণ। এর পরিমাণ বাড়ছে। দিন দিন বাড়ছে। এরই লেজে লেজে সমস্যা তৈরি হচ্ছে ‘প্রভিশনিং’-এর, মূলধন সংগ্রহের। বলা হচ্ছে অনিয়ম ও দুর্নীতিই মূল কারণ। ঠিক আছে, এই আলোচনা তো হচ্ছে দশকের পর দশক ধরে। আগে হতো শুধু সরকারী ব্যাংকের ওপর। এখন যোগ হয়েছে বেসরকারী ব্যাংকও। সঙ্গে রয়েছে লিজিং কোম্পানি, রয়েছে বীমা কোম্পানি। কোনটাই সমস্যামুক্ত নয়। শুধু ব্যাংক কেন, দেশের কোন্্ খাতে সমস্যা নেই? কোন্ আর্থিক খাত সমস্যামুক্ত? তাই বলে তো এসবকে আবেগের বিষয়ে পরিণত করা কি বুদ্ধিসম্মত? না, সমস্যাকে বাস্তবতা দিয়ে বিচার করা যুক্তিসঙ্গত? মনে হয় এক শ্রেণীর লোক সমস্যাগুলোকে আবেগ দিয়ে দেখতে চান। আবেগের বিষয়ে জনগণ আন্দোলিত হয়। তাদের সামনে যুক্তি তুলে ধরা হয় না। ফলে তারা আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। এতে পরিণামে দেশের কোন মঙ্গল হয় না। যেমন ধরা যাক এই মুহূর্তের একটা আলোচিত বিষয়কে। তারল্য সঙ্কটের কথা বলছি। একটি ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এটা নির্দিষ্ট একটা ব্যাংকের সমস্যা। সমস্ত ব্যাংকিং খাতের সমস্যা নয়। কোন গ্রাহক অন্য কোন ব্যাংকের টাকা তুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে এসেছেন এমন খবর কেউ কী শুনেছি আমরা? কোন কাগজ কী এমন খবর দিয়েছে? না, আমি অন্তত এ খবর পড়িনি। তাহলে তারল্য সঙ্কট, তারল্য সঙ্কট বলছি কেন? এতে তো ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এতে কার লাভ, কার ক্ষতি? আমার মনে হয় আর্থিক খাতের খবর দেয়ার সময় আমাদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার। কারণ কোটি কোটি লোকের আমানত এখানে রক্ষিত। এতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করলে পরিণামে কারও মঙ্গল হবে না। মনে রাখা দরকার আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্রই ব্যাংকিং খাতের সমস্যা চলছে। এর মূলে একটা জিনিস কাজ করছে বলে আমার মনে হয়। ধরা যাক, শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের কথা। শ্রেণিবিন্যাসিত ঋণ কাকে বলে এর সংজ্ঞা আছে। সংজ্ঞাটা দেয়া ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট (বিআইএস) কর্তৃক। এটা অঙ্কের মতো ফর্মুলা। এদিক-সেদিক করার উপায় নেই। ব্যতিক্রম হওয়ার উপায় নেই। অথচ যাদের নিয়ে ব্যাংকের কারবার সেই ‘ব্যবসা’ অঙ্কের মতো চলে না। ব্যবসা সব সময় ভাল যায় না। সারা বছর ভাল যায় না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ভাল যায় না। ব্যবসায় উত্থান-পতন আছে। উত্থান-পতনে ব্যাংকের হয় লাভ হয়, নয় ক্ষতি। ‘শ্রেণিবিন্যাসকরণের নীতি’ এই উত্থান-পতন মানতে চায় না। এই নীতি অঙ্কের মতো কাজ চালায়। এবং তা সারা বিশ্বেই। একই নিয়ম সর্বত্র। স্কুলছাত্রদের ইউনিফরমের মতো। একেক দেশের অর্থনীতির স্তর একেক। নিয়মনীতি ভিন্ন রকম। ব্যবসার অবস্থা একেক রকম। সমাজ ও রাজনীতি ভিন্ন ভিন্ন। অথচ শ্রেণীবিন্যাসকরণ, পুঁজি সংরক্ষণ, সঞ্চিতি সংরক্ষণের নীতি-নিয়ম এক। এই বিষয়টি এখন সব দেশে আলোচিত-সমালোচিত। ধরা যাক ‘কোল্ড স্টোরেজ’ ব্যবসার কথা। গেল বছর গোল আলুর ব্যবসা খারাপ গেছে। অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে গোল আলুর দাম পায়নি কৃষক। কোল্ড স্টোরেজওয়ালারা প্রচুর লোকসান দিয়েছে। ৩০টির মতো কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন এই ফিন্যান্সের কী হবে? কোল্ড স্টোরেজে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রচুর ফিন্যান্স। টাকা আদায় নেই। অতএব তারা ঋণখেলাপী। ঋণখেলাপী হবে অঙ্কের নিয়মে। আবার অঙ্কের নিয়মেই যখন পুনঃতফসিল হবে তখন হবে ভিন্ন সমালোচনা। একই কথা সঞ্চিতিরক্ষণ, পুঁজিরক্ষণ ইত্যাদির ক্ষেত্রেও। আমি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীর কথা বলছি না। বলছি স্বাভাবিক ব্যবসা করতে গিয়ে যে উত্থান-পতনের সম্মুখীন হতে হয় তার ধকল কিভাবে ব্যাংক সামলাবে এর কোন ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপত্রে নেই। তাহলে কী হবে? এই বিষয়গুলো মিডিয়ায় আলোচিত হওয়া দরকার। তাহলে দেশ উপকৃত হবে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবসা ভাল থাকার পরেও টাকা ফেরত দেয় না তাদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি আক্রমণ হোকÑ কারও কোন আপত্তি নেই। এর জন্যই মিডিয়া ঢালাওভাবে সমালোচনা করে একটা কাজ করতে পারে। শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের ওপর ‘কেস স্টাডি’ করে রিপোর্ট করতে পারে। এতে কারণ বেরিয়ে পড়বে। কে ব্যবসায়িক কারণে, কে প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখিয়ে ব্যাংকের টাকা দিচ্ছে না, কেউ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে কি না, কেউ কারখানা-ব্যবসা না করে জমি-শেয়ারে টাকা খাটাচ্ছে কিনা এসব জানা দরকার। খেলাপী ঋণের ওপর এই কাজটি করলে দেশবাসী উপকৃত হবে। বিপরীতে খেলাপী ঋণ বাড়ছে এই খবরে পাঠকদের কোন লাভ নেই। কেন বাড়ছে, কী কারণে বাড়ছে তাও জানা দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×