ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার মাসে অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক জাগরণ উৎসবমুখর রাজধানী

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

ভাষার মাসে অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক জাগরণ উৎসবমুখর রাজধানী

মোরসালিন মিজান ॥ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে নতুন প্রাণ পেয়েছে ঢাকা। রাজধানী শহরের প্রতি প্রান্তে এখন উৎসব অনুষ্ঠান। শিল্প সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। চলছে বহুবিধ পরিবেশনা। সাংস্কৃতিক এ জাগরণ দেখে মন ভরে যায়। ভাষার মাসের প্রধান আয়োজনটি নিঃসন্দেহে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। জাতীয় কবিতা উৎসবেরও আছে সংগ্রামের ইতিহাস। একই সময় চলছে আরও অনেক আয়োজন। নাট্য উৎসব, নৃত্য উৎসব, চলচ্চিত্র উৎসব, আর্ট সামিট, পাপেট শো সবই একসঙ্গে! সারা বছর এ ধরনের আয়োজন থাকে বটে। এখন সবচেয়ে বেশি। শিল্প সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ ঘুরে ঘুরে উৎসব অনুষ্ঠানগুলো দেখছে। উপভোগ করছে। মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে থাকা মানুষের মনের ক্ষুধা দূর হচ্ছে এভাবেই। অমর একুশে গ্রন্থমেলার কথাই আগে বলতে হবে। প্রাণের মেলা ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস ধারণ করে আছে। মাসব্যাপী মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় গত বৃহস্পতিবার। দ্বিতীয় দিন শুক্রবার হওয়ায় পুরোদমে জমে ওঠে মেলা। মূল মেলাটির আয়োজন করা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। শুক্রবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, উৎসবের আমেজ। একুশের ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখেই চলছে বইয়ের উৎসব। প্রায় প্রতিটি স্টল ও প্যাভিলিয়নের সামনে পাঠকের বিপুল উপস্থিতি। নতুন বইয়ের খোঁজ করছিলেন তারা। উৎস প্রকাশনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফের সঙ্গে। তরুণ পাঠক বললেন, বইমেলাটা আগেভাগে দেখার একটা আনন্দ আছে। গতকাল অনেক পরে মেলার গেট খুলে দেয়া হয় বলে ঢুকতে পারিনি। আজকে তাই ঢু মারলাম। বই কেনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী ঐশি বললেন, এসেছিলাম তো দেখার জন্য। একটু ঘুরে বেড়ানোর জন্য। কিন্তু পছন্দের বই হাতে নিয়ে আর রাখতে মন চাইলো না। সন্ধ্যার আগে আগে জমে ওঠিল আড্ডা। লেখক পাঠক প্রকাশকদের অনেকেই এসেছিলেন। কাছেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দল বেঁধে এসেছিলেন ছাত্র-ছাত্রীরা। কেউ বই কিনেছেন। কেউ ফিরেছেন খালি হাতে। তাতে কী? শুরুটা তো হলো। বইয়ের উৎসব চলবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিন পর্যন্ত। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হামিক চত্বরে শুরু হয় জাতীয় কবিতা উৎসব। ৩২তম আয়োজনের মঞ্চ থেকে দেশহারা মানুষের অধিকারের কথা হয়। দুই দিনব্যাপী উৎসবে অংশ নেন প্রায় ৩০০ কবি। সারা দেশ থেকে আসা কবিরা তাদের কবিতা পড়ে শোনান। আমন্ত্রিত হয়ে উসবে যোগ দেন ৮ দেশের ১৬ কবি। তারাও স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। ছড়াপাঠ, প্রখ্যাত আবৃত্তিশিল্পীর পরিবেশনা, মুক্ত আলোচনা, কবিতার গান, সেমিনারসহ বহুমাত্রিকতায় আয়োজন উৎসবে। সমাপনী দিন শুক্রবার বিদেশী কবিরা ঢাকার বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। ঘুরে দেখেন বইমেলাও। বাংলা ভাষার গৌরবের অংশ হতে পেরে সবাই ভীষণ খুশি। আবেগ ভালবাসার উৎসব শুক্রবার শেষ হয়েছে। চলছে নাটকের উৎসবও। গত বুধবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ৮ দিনব্যাপী পথনাট উৎসবের উদ্বোধন করা হয়। এবারের স্লোগানÑ প্রগতির যাত্রাপথে মশাল জ্বালাও, ভাষা-কৃষ্টির শক্তি নিয়ে বিশ্ব কাঁপাও। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন আয়োজিত উৎসবে প্রতিদিন চলছে নাটকের প্রদর্শনী। নাটকের আরেকটি উৎসব চলছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্ত মঞ্চে। বইমেলার পাশে হওয়ায় এখানেও ভিড় করেছেন দর্শক। শুক্রবার নৃত্য উৎসবের আয়োজন করা হয় ছায়ানটে। এতে মণিপুরী ভরতনাট্যম কত্থক নাচ পরিবেশন করেন শিল্পীরা। ছায়ানটের আয়োজন যেহেতু, স্বতন্ত্র একটি আবেদন ছিল। সন্ধ্যায় উৎসব শুরুর আগেই ভরে ওঠেছিল মিলনায়তন। ছায়ানট, নৃত্যম নৃত্যশীলন কেন্দ্র, একাডেমি ফর মণিপুরী কালচার এ্যান্ড আর্ট, সৃষ্টি কালচারাল সেন্টার, জাগো আর্ট সেন্টার, কত্থক নৃত্য সম্প্রদায় ও নৃত্যাঞ্চলের শিল্পীদের পরিবেশনা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন দর্শক। শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয়েছে ঢাকা আর্ট সামিট। শুক্রবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। বৃহৎ প্রদর্শনীর আয়োজক সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন। প্রদর্শনীতে ৩৫ দেশের প্রায় ৩০০ শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের আছেন শতাধিক শিল্পী। সামিটে এবার প্রথমবারের মতো সম্পৃক্ত হতে যাচ্ছে ইরান ও তুরস্ক। চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, ভিডিও আর্টসহ থাকছে মাল্টিস্টেজ পারফরম্যান্স প্রোগ্রাম। প্রদর্শনী ঘিরে এখানেও উৎসবের আমেজ। চলছে প্যানেল আলোচনা ও সিম্পোজিয়াম। মোট ১৬টি প্যানেল আলোচনা এবং ২টি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হবে। প্রখ্যাত বাংলাদেশী শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদ, এম এম সুলতানসহ অন্যান্য বরেণ্য শিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে আলাদা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। তারও আগে থেকে শুরু হয়েছিল চিলড্রেনস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। ১১তম আয়োজন শনিবার শেষ হয়েছে। সপ্তাহব্যাপী আয়োজনে দারুণ মেতেছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। উৎসবের ভেন্যুগুলোর মধ্যে ছিলÑ জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, ধানমন্ডির অলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, গ্যাটে ইনস্টিটিউট, ব্রিটিশ কাউন্সিল ও শিল্পকলা একাডেমি। প্রতিটি ভেন্যুতে প্রতিদিন ৪টি করে চলচ্চিত্র দেখানো হয়। সব সময় উৎসবমুখর ছিল প্রধান ভেন্যু জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তন। অঙ্গনটিকে চমৎকার সাজিয়ে নেয়া হয়েছিল। সিনেমার ডিজিট্যাল ব্যানার, দেশী-বিদেশী নির্মাতাদের ছবি টানানো হয়েছিল এখানে ওখানে। ফেস্টিভ্যাল অফিস, ফেস্টিভ্যাল লাউঞ্জ, ডেলিগেটস, সেলস ইত্যাদি নামে ছিল বেশকিছু স্টল। কিশোর-কিশোরীরা মজা করে ছবি দেখেছে। চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ আয়োজিত উৎসবে ৫৮ দেশের ২ শতাধিক শিশুতোষ চলচ্চিত্র দেখানো হয়। উৎসবে স্কুলের ছেলেমেয়েরা বিনা টিকেটে সিনেমা উপভোগ করে। চলচ্চিত্রের গুণমান বিচার করে পুরস্কারের জন্য নাম চূড়ান্ত করার কাজও করে তারা। এসবের বাইরে উৎসবে আসা প্রতিনিধিদের জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। আড্ডা চলে বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে। অন্যরকম মিলমেলা শুক্রবার শেষ হয়েছে। আজ শনিবার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে থাকছে মুক্তধারার আবৃত্তি প্রযোজনা ‘জন্ম মৃত্যু জীবনযাপন।’ তামান্না সারোয়ার নীপার গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় সন্ধ্যায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। এখানেই শেষ নয়, সামনে আছে আরও অনেকগুলো উৎসব অনুষ্ঠান। বিশেষ করে আসন্ন ফাল্গুনে ফুলের উৎসবে রঙের উৎসবে মাতবে বাঙালী। সে হাওয়া এখনই বইতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক জাগরণ। এই বাঙালীত্বের জয় হোক।
×