ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাবাসন না হলে লাভ অনেকের

রোহিঙ্গা সঙ্কট মিয়ানমারের হলেও বোঝা বইছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

রোহিঙ্গা সঙ্কট মিয়ানমারের হলেও বোঝা বইছে বাংলাদেশ

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতনের দায়ভার যেন একান্তই বাংলাদেশের। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা ইতোমধ্যেই সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায়। বাকিদের ঝোঁকও এদিকে। বিষয়টি ওই দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হলেও বোঝাটা চেপেছে বাংলাদেশের ওপর। এই রোহিঙ্গারা থেকে গেলে অনেকেরই লাভ। তাই চলছে নানা ইস্যু সৃষ্টি করে অনুপ্রবেশকারীদের উত্তপ্ত রাখার চেষ্টা। বিভিন্ন দাবিদাওয়া উঠিয়ে উস্কে দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। এক্ষেত্রে সক্রিয় রয়েছে রোহিঙ্গা নিয়ে কাজ করা কিছু এনজিও এবং দালালচক্র। কারণ, এরা ফিরে গেলে ফান্ড আসবে না। বন্ধ হয়ে যাবে এনজিওর প্রজেক্ট এবং কিছু ব্যবসায়ী ও দালালের কারবার। কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা ক্রমেই নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছে এদেশের জীবনযাত্রার সঙ্গে। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মানবিক সহায়তাও রয়েছে। আসছে তাদের জীবনমান উন্নয়নে নানা ধরনের সুপারিশ। কিন্তু দারুণ অস্বস্তিতে রয়েছে স্থানীয় অধিবাসী। স্থানীয়রা মনে করছে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষা করা মানে তাদের মানবাধিকার ক্ষুন্ন করা। কেননা, বাড়তি এই জনসংখ্যার চাপ জনজীবনে ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার পরও ভর করে আছে অনিশ্চয়তা। তালিকা করতে হবে নতুনভাবে, যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু এরমধ্যে বসে নেই স্বার্থসংশ্লিষ্টরা। নাগরিকত্বের দাবি, সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ, ক্ষতিপূরণসহ নানা দাবিতে রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করার কাজটিও চলছে । রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে বিভিন্ন দাবিতে উত্তপ্ত রাখতে পারলে তাদের অবস্থান দীর্ঘায়িত হতে পারে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের হাতে রোহিঙ্গা খুন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ বিভিন্ন বিষয় প্রকাশিত হতে থাকলে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকার কোন একপর্যায়ে গড়িমসি করতে পারে। স্থানীয়দের অভিমত, রোহিঙ্গারা তাদের জায়গায় ফিরে যাবে এটাই আমাদের চাওয়া হওয়া উচিত। তাদের দাবি আদায় করে দেয়ার কাজ বাংলাদেশের হতে পারে না। এর জন্য জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রয়েছে। প্রত্যাবাসনের শর্ত হওয়া উচিত ফিরিয়ে নেয়া রোহিঙ্গাদের যেন আবারও সীমান্ত অতিক্রম করতে না হয় সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। উখিয়া উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছে এমন কিছু এনজিও সংগঠন উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায়। দুদেশের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর এবং ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের পর থেকেই এনজিওগুলোর নেতিবাচক তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক এনজিও রয়েছে, যেগুলোর কার্যক্রম প্রজেক্ট নির্ভর। রোহিঙ্গারা চলে গেলে চলমান প্রজেক্ট বন্ধ হবে এবং নতুন প্রজেক্ট আর আসবে না এ আশঙ্কায় তারা নানা কৌশলে রোহিঙ্গাদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টায় রয়েছে। ইতোমধ্যেই সরকারী নির্দেশনা অমান্য এবং অনৈতিক কার্যক্রমের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ১২টি এনজিওর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এনজিওগুলো হচ্ছে সাফজ, কালব, ওফকা, জাগরণ, এমপিডিআর, মানবাধিকার, শেড ওয়াশ, টাই বিডি, এসআরপিবি, গ্রামীণ ব্যাংক, লাচুন ও শিলাফ। এর আগে নিষিদ্ধ করা হয় মুসলিম এইড বাংলাদেশ, ইসলামিক রিলিফ এবং ইসলামিক এইড নামের তিনটি এনজিওর কার্যক্রম। কিন্তু তারপরও থেমে নেই রোহিঙ্গানির্ভর বেসরকারী সংস্থাগুলোর কৌশলী কার্যক্রম। রোহিঙ্গাদের অবাধ অনুপ্রবেশ এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ভ-ুল করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা বলছে, দাবিগুলো মূলত এনজিওগুলোই তুলে ধরছে দেশী-বিদেশী সংস্থাগুলোর কাছে। এ ধরনের নেতিবাচক ভূমিকার প্রতিবাদে গত ২৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার উখিয়ায় একটি সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিঘিœত করার বিরুদ্ধে সোচ্চার কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আন্দোলনসহ স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠনগুলো। ওই সমাবেশ থেকে উস্কানিদাতা এনজিওদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও তুলে ধরা হয়। এছাড়া আগামী ৩০ জানুয়ারি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে উখিয়ায় অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচীও রয়েছে। কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা যেন রাখাইনে ফেরত না যায় সে জন্য অধিকার সংক্রান্ত কিছু ইস্যু এনে তাদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে। বাড়তি জনসংখ্যার কারণে চাপের মুখে থাকা স্থানীয় বাংলাদেশীরা বলছেন, আপদকালীন মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হলেও তাদের অধিকার আদায় করে দেয়ার কাজ আমাদের হতে পারে না। তারা কিভাবে তাদের দাবি আদায় করে নেবে সেটি একান্তই তাদের ব্যাপার। রাখাইন প্রদেশে এখন কোন দমনপীড়ন বা সেনা অভিযান চলছে না। প্রত্যাবাসনের আলাপ-আলোচনায় যেহেতু এক ধরনের সমঝোতা হয়েছে সেহেতু নতুন করে আরও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে ঠেকানো জরুরী। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মতো অবারিত বর্ডারের উদাহরণ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সীমান্তে অবশ্যই কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে।
×