ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করতে কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে

বিডিনিউজ ॥ দেশের মঙ্গলের জন্য সব সময় আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে থাকেন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার রাজনীতি কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের রাজনীতি। প্রধানমন্ত্রী বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বেপজা ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টরস সামিট-২০১৮’র উদ্বোধনীতে দেয়া বক্তব্যে এ কথা বলেন। উদ্বোধনীতে দেশের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোয় (ইপিজেড) স্থানীয়দের কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্বারোপ করে সেখানে শ্রমিকদের কোন সমস্যা থাকলে তা সমাধানেরও আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য সরকার মূলধন এবং মুনাফা প্রত্যাবাসন, ট্যাক্স হলিডে প্রদানসহ বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিচ্ছে। তুলনামূলক সস্তায় দক্ষ জনবলের কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুত, জ্বালানি, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কিছু মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন থাকার কথাও বলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, আমি এতটুকু আশ্বাস দিতে পারি, আমি শুধু প্রধানমন্ত্রী নই, আমি জাতির পিতার কন্যা, আমি আপনাদের প্রতিনিধি। আপনাদের কোন সমস্যা থাকলে সেটা আমরা নিশ্চয়ই দেখব। “আমি আর পাঁচটা প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের মতো নই। আমি কাজ করি..., আমি কাজ করি আমার দেশের কল্যাণে, আমার দেশের মঙ্গলের জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে।” এই অনুষ্ঠান থেকেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এক হাজার ১৫০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অর্থনৈতিক অঞ্চল উদ্বোধন করেন তিনি। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে ‘ইপিজেড শ্রমিক কল্যাণ সংঘ ও শিল্প সম্পর্ক আইন-২০১০’ প্রণয়নের বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী ইপিজেডের শ্রমিকদের গোপন ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার কথাও বলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ট্রেড ইউনিয়নের মতো শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন দুই দফায় বাড়ানোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বদা সচেষ্ট। ইপিজেডের বাইরের পোশাক খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা বৃদ্ধির জন্য আমরা নিম্নতম মজুরি কমিশন গঠন করেছি। কোন উস্কানিতে শ্রমিকদের প্রলুব্ধ না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কলকারখানা আছে বলে এবং সেখানে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন বলেই আপনারা অর্থ উপার্জন করতে পারছেন, পরিবার-পরিজনকে দেখাশোনা করতে পারছেন এবং নিজেরাও স্বাবলম্বী হতে পারছেন। কাজেই একটি অনুরোধ আমার থাকবে..., যে কলকারখানা আপনাদের মুখের অন্ন যোগায়, আপনাদের জীবনমান উন্নত করে তার যেন কোন ক্ষতি না হয় বা বাইরের কারো উস্কানিতে আপনারা যেন কোনমতেই আপনাদের কর্মক্ষেত্রের কোন ক্ষতি না করেন, সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন। তিনি বলেন, যারা কাজ করে না, শ্রম দেয় না তারা সংগঠন করার নামে অনেক সময় নানা ধরনের কর্মকা- করে, যার ফলে একটা অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। কারো উস্কানিতে আপনারা প্রলুব্ধ হবেন না বা এমন কিছু করবেন না, যাতে আপনাদের এই শিল্প, কলকারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইপিজেডের শ্রমিকদের কল্যাণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ইপিজেডের শ্রমিকরা বিনামূল্যে ওষুধ ও স্বাস্থসেবা পাচ্ছেন। নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন। ইপিজেডে বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজগুলোতে শ্রমিকের ছেলেমেয়েরা কম খরচে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। অধিকাংশ ইপিজেডেই ডে-কেয়ার সেন্টার রয়েছে। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ ইপিজেডগুলোকে ইতোমধ্যে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে দেশ-বিদেশে সুপরিচিত করেছে বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান। বেসরকারী খাতকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর এই বেসরকারী খাতকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং উন্মুক্ত করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য চট্টগ্রাম ইপিজেড এবং স্বল্প পরিসরে ঢাকা ইপিজেড চালু করে। পরবর্তীকালে বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম ইপিজেডের সম্প্রসারণ এবং কুমিল্লায় ইপিজেড স্থাপন করে। পিছিয়েপড়া অঞ্চলগুলোতে শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মংলা, ঈশ্বরদী ও নীলফামারীতেও ইপিজেড স্থাপন করা হয় সে সময়ে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বেপজার বিনিয়োগ দ্বিগুণের বেশি এবং রফতানি প্রায় আড়াইগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। বেপজার ইপিজেডগুলো দেশের মোট জাতীয় রফতানি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ২০ শতাংশ অবদান রাখছে বলেও মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাদের বিনিয়োগবান্ধব নীতির ফলেই চীন, জাপান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৩৮টি দেশের বিনিয়োগকারীগণ ইপিজেডের কারখানায় বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড পণ্য উৎপাদন করছে। এত বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ আর কেউ হয়ত দিতে পারবে না। দেশের আটটি ইপিজেড মাত্র দুই হাজার ৩০৭ দশমিক ২৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই আটটি ইপিজেডে মোট ৪৬৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে, যাতে পাঁচ লাখ বাংলাদেশীর কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এদের শতকরা ৬৪ ভাগই নারী। নয় বছরে ইপিজেডগুলোতে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬২০ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। জমির স্বল্পতার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের জমির পরিমাণ সীমিত। এই সীমিত জমি আর ১৬ কোটির ওপর মানুষ আমাদের। তাদের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হবে, বাসস্থান দিতে হবে। তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। কাজেই আমাদের জমি বাঁচিয়ে রেখে শিল্প উৎপাদন বাড়ানো এবং শিল্প, কলকারখানা গড়ে তোলা, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা এটাই চাই, কোনমতেই যেন আমাদের কৃষিজমি নষ্ট না হয়, আবার শিল্প-কলকারখানাও যেন গড়ে ওঠে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই যে সমস্ত এলাকায় ফসল বেশি হয় না বা ফসল একেবারেই উৎপাদন হয় না, অনুর্বর জমি সেসব জমি আমরা বেছে নিচ্ছি। সেখানেই আমরা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এবং ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতু সারা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ১৬ হাজার ৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কয়লাভিত্তিক ও থার্মাল বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে চলছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজও সন্তোষজনক গতিতে এগিয়ে চলছে। ভারত থেকে ৬০০ মেগাওয়াট আমদানি করেছি। আরও দুই হাজার মেগাওয়াট যাতে আমদানি করা যায় সে বিষয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছি। তিনি বলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলাদেশ একটি চমৎকার জায়গা। যেখানে বিনিয়োগের জন্য সব থেকে উপযুক্ত জায়গা। যেখান থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সব জায়গায় যোগাযোগ করা যাবে। পণ্য আমদানি ও রফতানি করা যাবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ইপিজেডে কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) চালু হয়েছে। আদমজী ইপিজেডের একটি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বিশ্বের গ্রীন ফ্যাক্টরির তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পের সঙ্গে পরিবেশ রক্ষা করা একান্ত জরুরী। অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, বাংলাদেশ ইপিজেড এ্যাডভাইজার্স এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এম নাসির উদ্দিন, উত্তরা ইপিজেডের এভারগ্রীন প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের চেয়ারম্যান চাং উয়ো চং এবং কর্ণফুলী ইপিজেডের একটি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজার (প্রডাকশন) পান্না ইয়াসমিন বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোঃ হাবিবুর রহমান খান স্বাগত বক্তব্য রাখেন। শুরুতেই বেপজার কার্যক্রমের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
×