ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

কোচিং নিয়ে আবার পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৭ জানুয়ারি ২০১৮

কোচিং নিয়ে আবার পরিকল্পনা

আবার কথা উঠেছে কোচিং সেন্টার নিয়ে। পরিকল্পনা চলছে যার প্রায় পুরোটাই বাস্তবতা বর্জিত। পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর পেতে হবে কিন্তু ক্লাসে সে নিশ্চয়তা নেই। অভিভাবক দিশেহারা। এই সুযোগ ডেকে আনে কোচিং সেন্টারকে। মেধা প্রতিভা যোগ্যতা যাচাইয়ের একমাত্র পথ নম্বর হলে যে কোন মূল্যে তা অর্জনের চেষ্টা চলবেই। আর আজকের বাজারি যুগে এরকম একটি বিষয় নিয়ে বাণিজ্যও হবে। কোচিং বাণিজ্য উচ্ছেদ করতে হলে সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। কোচিং বন্ধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় ক্লাসে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেয়া। সেজন্য প্রয়োজন যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক। কিন্তু শিক্ষকদের জন্য যে বেতন স্কেল নির্ধারণ করা আছে তা মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করে না। যাঁরা আসছেন তাঁরা বেতনের ওপর নির্ভর করে চলতে পারেন না। এই বাস্তবতাও কোচিংয়ের পক্ষে যায়। কিন্তু যেভাবে এর বিস্তার অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাড়ছে তাতে শুধু অভিভাবকরা বিপর্যস্ত হচ্ছেন না শিক্ষার ভিতই অন্তসারশূন্য হচ্ছে। নম্বরভিত্তিক প্রতিযোগিতার ফলে কোচিং সেন্টার নির্দিষ্ট ছকে ফেলে শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে কিন্তু মেধা ও সৃজনশীলতার পুরো বিষয়ই উপেক্ষিত থাকছে। তারা শিক্ষক পাচ্ছে না ভাল ফল করার গাইড পাচ্ছে। যারা কিছু কৌশল রপ্ত করাচ্ছেয় যা দিয়ে শিক্ষার্থী পুরো শিক্ষা জীবনের বৈতরণী পার হয়ে আসছে। কিন্তু একজন সঠিক মানুষ হওয়ার কলাকৌশল সে কতটা রপ্ত করল তা যাচাইয়ের সুযোগ কমতে কমতে প্রায় শূন্যে ঠেকেছে। এত বেশি প্রতিযোগিতা এত বেশি পরীক্ষা একেবারে জীবনের শুরু থেকে এর প্রয়োজন কতটা আছে তাও প্রশ্নহীন নয়। এই যে পাসের এত ছড়াছড়ি এত জিপিএ ফাইভ শেষ পর্যন্ত এর গন্তব্য কোথায় কে জানে। প্রতিযোগিতাকে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ায় বছর বছর একগুচ্ছ কচি মুখে তথাকথিত সাফল্যের হাসি দেখছি আমরা এর পেছনেও রয়েছে কোচিং সেন্টার। এই সাফল্য শিক্ষামন্ত্রীর রাজনৈতিক সফলতার পালে হাওয়া লাগালেও শিশুরা শিক্ষার কোন গতি মুখের দিকে যাচ্ছে তা শিশু মনোবিদরাই ভাল বলতে পারবেন। এদের জীবনই শুরুহচ্ছে কোচিং এর ফাঁদে পা দিয়ে। শিক্ষা পদ্ধতির এমন বিন্যাসে পরিবর্তন না এনে কোচিং কি আদৌ বন্ধ করা সম্ভব? বছর কয়েক আগে কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন অভিভাবক এবং শিক্ষকদের একটি অংশ। সে সময় আদালতে রিট হয়েছিল। সরকারী ও বেসরকারী এমপিওভুক্ত স্কুল শিক্ষকদের ক্লাসের বাইরে কোচিংয়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিল। এ বিষয়ে সরকারকে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ কেন দেয়া হবে না জানতে চেয়েছিল। চার সপ্তার মধ্যে সরকারের পক্ষে শিক্ষা সচিবসহ কয়েকজন সচিব এবং শিক্ষকদের পক্ষে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতিও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান এবং ঢাকার প্রথম সারির কয়েকটি স্কুল কর্তৃপক্ষসহ বিশজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছিল। অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতির রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ রুল জারি হয়েছিল। সে সময় হাইকোর্টের আদেশকে স্বাগত জানিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। বলেছিলেন, আমরাও এর পক্ষে। আমরা চাই দেশ থেকে কোচিং ব্যবস্থা উঠিয়ে দিতে। নির্ধারিত সময়ে রুলের জবাব দিতে অক্ষমতা জানিয়ে আদালত থেকে সময় নিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। রুলে যাদের জবাব দিতে বলা হয়েছে তাদের নিয়ে পাঁচ বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠক শেষে জানান সরকার কোচিং বাণিজ্যে জড়িত শিক্ষকদের তালিকা করছে। যে শিক্ষকরা ক্লাসের বাইরে কোচিং করাচ্ছেন তাঁদের তালিকা করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করা হবে। কোচিং বন্ধে সরকার শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে রয়েছে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয় বলে দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ক্লাসরুমে পূর্ণ শিক্ষা পেলে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে যাবে না। আর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান কোচিংয়ের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে সরকারী স্কুল-কলেজের যে শিক্ষকরা কোচিংয়ে জড়িত তাদের বদলি করতে বলেছেন। আর বেসরকারী বিদ্যালয়ের কোচিংয়ে যুক্ত শিক্ষকদের নিয়ে কি করা যায় সে বিষয়ে গঠিত কমিটি সুপারিশমালা তৈরি করবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর মতের বিধি অনুযায়ী কোন সরকারী কর্মচারী সরকারের অনুমতি ছাড়া অন্য কোন ব্যবসায় জড়িত হতে পারবেন না। কোন সরকারী কর্মচারী এর ব্যত্যয় ঘটালে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবেন। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর থেকে বেসরকারী শিক্ষকদের কোচিং বন্ধে আইন করার প্রস্তাব করেছে। শিক্ষকদের যুগোপযোগী বেতন স্কেল ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতের পাশাপাশি কোচিংয়ের জন্য অভিভাবকদের নিরুৎসাহিত করার কথা বলেছে। কোচিং নির্ভরশীলতা কমিয়ে ক্লাসেই প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত কমপক্ষে ১ : ৩০ করাসহ স্কুলে পরীক্ষায় ফল খারাপ হলে শ্রেণী শিক্ষককে জবাবদিহির আওতায় আনার কথাও বলেছে। এসব প্রস্তাবের পাশাপাশি যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিও নিশ্চিত করা অন্যতম জরুরী। একজন ভাল শিক্ষকের প্রভাব যেমন আজীবন রয়ে যায় খারাপ শিক্ষকের নেতিবাচক প্রভাবও তেমনি। অযোগ্য শিক্ষক যে ক্ষতি করে তার মাশুল দিতে গোটা জীবনই চলে যায়। দেশের প্রখ্যাত এক কথাসাহিত্যিক একবার বলেছিলেনÑ ‘এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাতে সম্ভব যে দেশের একজন নাগরিক প্রাথমিক শিক্ষায় ঢুকে উচ্চশিক্ষার ভেতর দিয়ে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে আসতে পারেন শিক্ষা বস্তুটি দ্বারা এতটুকু স্পর্শিত না হয়ে। মানুষকে এমন অপদার্থ ও অকর্মণ্য বানাবার কারখানা দুনিয়ার আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।’ এ কারখানার গোড়াপত্তন করে গেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা। যার উত্তরাধিকার আমরা আজও বইছি। শাসন-শোষণের সুবিধার জন্য কৃত্রিম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা সৃষ্টির পাশাপাশি গড়ে তুলেছিল কৃত্রিম শিক্ষাব্যবস্থা। ক্ষমতার ভিত মজবুত করতে এত আয়োজন করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল তারা। তবে নানা ক্ষেত্রে আমাদের এখনও কলোনিয়াল হ্যাংওভার রয়ে গেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় আজও মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। বরং স্বাধীনতার পর নিয়মতান্ত্রিক সরকারের পথ রোধ হওয়া ও সামরিক শাসনের আধিপত্য শিক্ষার গতি মুখকে কেবল নিচের দিকেই টেনেছে। এ অবস্থা বদলাতে শক্ত মেরুদ- নিয়ে দাঁড়াতে হবে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে। পরিমাণগত পরিসংখ্যানের চেয়ে গুণগত পরিসংখ্যানকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যও অনেক। গ্রাম শহরের বৈষম্য, মাদ্রাসা ইংরেজী মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা ক্যাডেট কলেজ ইত্যাদির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বৈষম্য নিয়ে চলছে শিক্ষার প্রক্রিয়া। এত অসঙ্গতি নিয়ে একটি স্বাভাবিক শিক্ষাব্যবস্থা এগোতে পারে না। কোচিং বাণিজ্য ভর্তিবাণিজ্য ইত্যাদি এর অনিবার্য উপসর্গ। শিক্ষাব্যবস্থার মূলে গলদ জিইয়ে রেখে কোচিংবাণিজ্য দূর করা সম্ভব নয়। কোন না কোনভাবে তা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবেই। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি সমন্বিত নীতিমালার মধ্যে এনে অনিয়মের জটগুলো একে একে খুলতে হবে। নইলে কোন সমস্যারই স্থায়ী সমাধান হবে না।
×