ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আলু শর্ষে বোরোর বীজতলা নিয়ে শঙ্কিত কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগও

ইঙ্কে কুয়া জন্মেও দেকিনি জারে হাড্ডি কাঁপিচ্চে...

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৮

ইঙ্কে কুয়া জন্মেও দেকিনি জারে হাড্ডি কাঁপিচ্চে...

সমুদ্র হক ॥ কুঁকড়ে গেছে আলু। নেতিয়ে পড়েছে হলদে ফুলের শর্ষে। বোরোর বীজতলা ভিজছে মৃদু বৃষ্টির মতো শিশিরে। ঘন কুয়াশায় বেড়ে যাওয়া সবজি স্থির। শীতের তীব্রতায় মাঠের ফসল বিপন্নপ্রায়। জখম হয়ে পড়েছে জমি। চিন্তার ও ফাঁপরে পড়েছে কৃষক। যেতে পারছে না মাঠে। আবাদ হবে কী ভাবে! অসময়ের গত বন্যায় ধানের আবাদ অনেকটা মার গেছে। পরবর্তী ফসলে তা পূরনের ইচ্ছা ছিল কৃষকের। সে আশা বরবাদ করে দিচ্ছে এবারের তীব্র শীত। ফসলের জন্য এই সময়টায় সূর্যালোকের খুবই দরকার। সেই সূর্য মুখ লুকিয়েছে ঘন কুয়াশার মেঘের আড়ালে। দুপুরের পর ক্ষণিকের জন্য সূর্য উঁকি দেয়। দ্রুত ফের ঢেকে যায়। আবাদ উদ্বৃত্ত উত্তরাঞ্চলের কৃষককের কথা- এভাবে ফসল হবে কি করে! কৃষকের এমন শঙ্কার সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ (ডিএই) চিন্তিত মাঠের আলু, শর্ষে ও বোরোর বীজতলা নিয়ে। এখন অপেক্ষা সূর্যালোকের। আবহাওয়া বিভাগ জানাচ্ছে সূর্যালোকের জন্য আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। তীব্র শীতের মাঘ শুরু হয়েছে। জানুয়ারি মাসেই আরও অন্তত দুটি শৈত্যপ্রবাহ ধেয়ে আসছে। বগুড়ার গ্রামে দেখা যায়- বোরোর বীজতলা নিয়ে মহা ভাবনায় পড়েছে কৃষকরা। সোনাতলার রানীরপাড়া গ্রামের গৃহস্থ সোলায়মান (৬৬) বললেন, গত শীত মৌসুমে ডিসেম্বরের মধ্যেই বীজতলা তৈরি হয়েছিল। জানুয়ারির শুরুতে চারা রোপণ করেছিলেন। এবার জমি ঠিকঠাক করতেই তীব্র শীত এসে সব এলোমেলো করে দেয়। শীতের সকালে ঘর থেকে বের হওয়া যায় না। তিনি ছেলেবেলায় এমন শীত অনুভব করে ঘন কুয়াশা ও শিশির দেখেছিলেন। বহু যুগ পর এত ঘন কুয়াশা ও শিশির দেখছেন। কৃষক সালজার (৪৮) বললেন ‘ইঙ্কে কুয়া জন্মেও দেকিনি। জারে হাড্ডি কাঁপিচ্চে। ব্যয়না ঘরত থাক্যে বাড়াবারই পারিচ্চি ন্যা। জমিত যামো কেঙ্কা করে (এ রকম কুয়াশা এই জনমে দেখিনি। শীতে হাড্ডি কাঁপছে। সকালে ঘর থেকে বের হতে পারছি না। জমিতে যাব কি করে)।’ গ্রামের আরেক কৃষক বাসেত আলী জানালেন, জমিতে যে আলু আছে সেই গাছ কুঁকড়ে গেছে। তিনি ভরসা পারছেন না কতটা আলু ঘরে তুলতে পারবেন। গত মৌসুমে আলুর আবাদ ভাল হয়েছিল। এবার যে কী হয়! টানা রোদ উঠলেই আলুর আবাদ ভাল হবে। সেই রোদই উঠছে না। কৃষক রফিকুল বললেন ‘এবার এত শর্ষের আবাদ হছিল বা। মাঠ এক্করে হলদে ফুল হয়া গেছিল। হ্যালে শর্ষে গাছের কোমর ভাঙ্গে পড়িছে। একনি যদি অদ না ওটে তাহলে কি যে হবি! কিষানক চোখে শর্ষে ফুল দেখা নাগবি। (এবার এত সরিষার আবাদ হয়েছিল মাঠ ভরে গিয়েছিল হলদে ফুলে। শীতে শর্ষে গাছ নেতিয়ে পড়েছে। এখনই যদি রোদ না ওঠে তাহলে যে কি হবে! কৃষককেই চোখে সরিষা ফুল দেখতে হবে)।’ সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়েছে বোরো আবাদের চাষীরা। সাধারণত জানুয়ারি মাসের মধ্যেই বোরোর অর্ধেক চারা রোপণ হয়ে যায়। এবার তা হয়নি। অনেকেই বীজতলা তৈরি করতে পারছেন না। যারা করেছেন তারা পলি ব্যাগে ঢেকে দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এদিকে ঘন কুয়াশা ও শীতে জমি জখম হয়ে গেছে। কৃষির পরিভাষায় বলা হয় কোল্ড ইনজুরি। সাধারণত ৫ থেকে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই কোল্ড ইনজুরি হয়। এবার বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুর ও আশপাশের এলাকায় ৫ থেকে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা চলে আসে। পঞ্চগড় নীলফামারী অঞ্চলে ২ দশমিক ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এই তাপমাত্রায় জমির ওপর ঘন কুয়াশার প্রলেপ পড়ে। কৃষকরা বলেন জখম। এই প্রলেপ কাটাতে অনেকটা সময় লেগে যায়। সূর্যালোকে এই কোল্ড ইনজুরি কেটে যায়। সেই সূর্যালোকও নেই। সবজি আবাদও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তীব্র শীতে। বেড়ে ওঠা সবজিগুলো স্থির হয়ে গেছে। কোথাও ঝরেও পড়ছে। কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলের কৃষক ভেবে পাচ্ছে না কি হবে এই শীতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর আলু শর্ষে বোরা আবাদ নিয়ে চিন্তিত। রবিবার সকালে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার গ্রামগুলোতে দেখা গেল, বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র মাঠপর্যায়ে গিয়ে আবাদের অবস্থা দেখছেন। আবাদ রক্ষায় কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন। যারা বোরো চারা করেছেন তাদের গভীর নলকূপের রাতে যে গরম পানি আসে তার সেচ দিতে বলছেন। সকালে এই পানি শীতল হলে তা জমি থেকে সরিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সূর্য না ওঠা পর্যন্ত পলিথিনে চারা ঢেকে দিতে বলছেন। আলু রক্ষায় এক ধরনের ওষুধ স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছেন। উপ-পরিচালক প্রতুল চন্দ্র জানালেন, বগুড়া অঞ্চলে চলতি মৌসুমে বোরোর টার্গেট করা হয় ১ লাখ ৯২ হাজার হেক্টর জমি। আলুর টার্গেট ৬৮ হাজার হেক্টর ও শর্র্ষের টার্গেট ২৪ হাজার হেক্টর জমি। কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও কৃষক আশাবাদী টানা রোদ উঠলেই আবাদের মোড় ঘুরে যাবে। ফলন ভাল হবে।
×