ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলার মোহময়তায় শুরু আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৪ জানুয়ারি ২০১৮

বাংলার মোহময়তায় শুরু আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন

মনোয়ার হোসেন ॥ হাজার বছরের ইতিহাস আশ্রিত বাঙালীর সংস্কৃতি। সেই সহস্র বছরের পুরনো সংস্কৃতিলালিত জীবন বলে শিল্প-সাধনার কথা। উচ্চারণ করে সম্প্রীতি আর শান্তির বারতা। বাঙালীর সেই ইতিহাস কখনোই বিভেদের কথা বলে না। বলে মানবিকতার কথা। বাংলা ভাষার সেই মানবিক মোহময়তার আহ্বানে শুরু হলো আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন। বাংলাভাষী বাংলাদেশ ও ভারতের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের সম্মিলনে ঘটেছে সাহিত্যের সঙ্গে শিল্পের মেলবন্ধন। বিষয়ভত্তিক ছয়টি সেমিনারের সঙ্গে মঞ্চনাটক, কবিতাপাঠ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও সঙ্গীত পরিবেশনায় সাজানো হয়েছে বিপুলা এ আয়োজন। ‘বিশ্ব মানব হবি যদি কায়মনে বাঙালী হ’ প্রতিপাদ্যে তিনদিনের এ সম্মেলনের সূচনা হয় শনিবার। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকেল ৫টার পর সম্মেলনের নানা আয়োজন শুরু হয় বাংলা একাডেমি আঙ্গিনায়। ছিল নাটক ও চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী। বর্ণিল আলোকে সাজানো একাডেমির উন্মুক্ত চত্বরে বসেছে বই বিতান। দেশের ছয়টি প্রকাশনা সংস্থার এই বই বিতানে যুক্ত হয়েছে কলকাতার দৈনিক পত্রিকা আজকাল এবং কলকাতার পাবলিশার্স এ্যান্ড বুক সেলারস গিল্ড। লালন মঞ্চে শোনা গেছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরসুধা। একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তন ও কবি শামসুর রাহমানের মিলনায়তনের সঙ্গে বহিরাঙ্গনে রবীন্দ্র, নজরুল, মঞ্চসহ অনেক আকাশ নামের তাঁবুতে বহুমাত্রিক আয়োজনে সাজানো হয়েছে সম্মেলন। সম্মেলনটির আয়োজক আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন পরিষদ। সহযোগিতায় রয়েছে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন ও ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ। বিকেল ৫টা থেকে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে শুরু সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এ সম্মেলন। রাত নয়টা পর্যন্ত চলে প্রথম দিনের আয়োজন। এদিনের আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যের সমকালীন ছোটগল্প’ শীর্ষক গল্পপাঠ ও আলোচনা পর্বটি। এর বাইরে একাডেমির বহিরাঙ্গনে প্রদর্শিত হয় দর্শকসমাদৃত দুই চলচ্চিত্র মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নেয়ামত আলী নির্মিত ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ এবং গৌতম ঘোষ নির্মিত ‘পদ্মানদীর মাঝি’। আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হয় ম্যাড থেটারের নাটক নদ্দিউ নতিম। এছাড়াও সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের কবি-সাহিত্যিকদের প্রীতি সম্মেলন। সন্ধ্যা ৬টায় কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলা সাহিত্যের সমকালীন ছোটগল্প’ শীর্ষক আলোচনা। এ অধিবেশনে প্রাণবন্ত আলোচনার পাশাপাশি স্বরচিত তিনটি গল্প পাঠ করেন বদরুন নাহার, জাহেদ মোতালেব ও মোজাফফর হোসেন। লেখক পারভেজ হোসেনের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন দেশের কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ও আহমাদ মোস্তফা কামাল এবং ভারতের দুই কথাসাহিত্যিক অভিজিৎ সেন ও স্বপ্নময় চক্রবর্তী। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলা ছোটগল্পের তুলনামূলক আলোচনায় আনিসুল হক বলেন, প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষার কোনো কবি কিংবা সাহিত্যিক আন্তর্জাতিকভাবে পঠিত হন না। এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর কারণ হচ্ছে তিনি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থটি নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্য রচিত হয়নি বা হচ্ছে না। সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হকের মতো লেখকদের সৃষ্টিকর্মগুলো নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিকমানের। কোনো এক অজানা পৃথিবীর মানুষ সেসব রতেœর খোঁজ রাখলো না। কোনো সাহিত্যকর্ম অনূদিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, সেটি আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হবে। সাহিত্যকর্মকে যে কোনো উপায়েই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে হবে। আন্তর্জাতিক সেই বিক্রয়যোগ্যতা এখনো আমরা অর্জন করিনি। অর্থনৈতিক বা সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হয়ে উঠলে হয়তো বাংলাদেশও সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসবে। আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, দেশভাগের মধ্য দিয়ে সীমানাকে দুই ভাগে ভাগ করা হলেও সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে বিভাজন রেখা টানা যায় না। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মূল বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করে। মূলত গত শতকের চল্লিশের দশকের এই ভূখ-ের সাহিত্যযাত্রা শুরু হয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লিখলেন ‘লাল সালু’, আবু ইসহাকের কলমে উঠে এলো ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’র মতো উপন্যাস। তাদের পরে যুক্ত হলেন শামসুদ্দীন আবুল কালাম, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো লেখকরা। তারা প্রতিকূল সময়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হলেন যোদ্ধা হিসেবে। সেই যুদ্ধটা তারা করলেন সাহিত্য দিয়ে। অনেক আকাশ তাঁবুতে ছিল ‘সাহিত্যের পরাগায়ন ও বাংলা সাহিত্য’ শীর্ষক উন্মুক্ত আড্ডা। এতে আলোচনা অংশ নেন কুমার চক্রবর্তী, জুয়েল মাজহার ও রায়হান রাইন। সঞ্চালনা করেন চঞ্চল আশরাফ। পৃথিবীর সঙ্গে অন্য ভাষার সাহিত্যের সংশ্লেষকে পরাগায়ন আখ্যা দিয়ে তরুণ লেখকরা বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে অন্য ভাষার একীভূতকরণের ক্ষেত্রে মৌলিকত্ব, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য কালেভদ্রে রাজনৈতিক চেতনার প্রভাবের নিদর্শন পাওয়া যায়। তবে সাহিত্যের এই পরাগায়নের ক্ষেত্রে বাস্তবতার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। অন্য ভাষার সাহিত্য থেকে প্রভাবিত হয়ে নতুন রচনায় বাস্তবতা উপেক্ষিত হলে, তা একান্তই অনুকরণীয় সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়। রাতে লালন মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন ভারতীয় কণ্ঠশিল্পী শ্রাবণী সেন। আজকের সম্মেলন : আজ রবিবার সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলবে ‘বাংলা সাহিত্যে দেশ ভাগের অভিঘাত’ শীর্ষক সেমিনার। আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিতব্য সেমিনারে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন গোলাম মুস্তাফা। আলোচনায় অংশ নেবেন সেলিনা হোসেন, ইমদাদুল হক মিলন, বীথি চট্টোপাধ্যায়, শাহীন আখতার প্রমুখ। একই মিলনায়তনে বেলা ২টা থেকে অনুষ্ঠিত হবে ‘সাহিত্য ও চলচ্চিত্র’ শীর্ষক সেমিনার। ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষের সভাপতিত্বে এ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন সাজেদুল আওয়াল। আলোচনায় অংশ নেবেন চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল, জাহিদুর রহিম অঞ্জন প্রমুখ। এদিন বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্রের ২০০ বছর’ শীর্ষক সেমিনার। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন স্নেহাশীস সুর। আলোচনায় অংশ নেবেন আবুল হাসনাত, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, শ্যামল দত্ত প্রমুখ। বিকেল ৫টায় শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে ‘সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাসের গতি ও গন্তব্য’ শীর্ষক আলোচনা। এ বিষয়ে আলোচনা করবেন ভারতের প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়সহ বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, আহমাদ মোস্তফা কামাল প্রমুখ। একই দিন বিকেলে রবীন্দ্র চত্বরে কবিতাপাঠের সঙ্গে আবহমান বাংলা গানের সুরে শ্রোতা-দর্শকদের হৃদয় রাঙাবেন বাংলাদেশ ও ভারতের কবি-শিল্পীরা।
×